অপরাজিতা

 

 

অঙ্কিতা আর রাহুলের সাজানো বাগানে প্রথম ফুলের মতো এসেছিল তাদের সন্তান ধারণের খবর। নয় সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা অঙ্কিতার পৃথিবীটা তখন রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ছিল। দুজনে মিলে কত স্বপ্ন বুনছিল তাদের অনাগত সন্তানকে ঘিরে। কিন্তু হঠাৎই এক কালবৈশাখী ঝড়ের মতো তাদের সাজানো জীবনে নেমে এলো অন্ধকার। ধরা পড়ল ক্যান্সার, অঙ্কিতার জরায়ুর ঠিক পেছনেই বাসা বেঁধেছে এক মারাত্মক টিউমার।

হাসপাতালের সাদা দেওয়ালগুলো যেন অঙ্কিতার রঙিন স্বপ্নগুলোকে এক মুহূর্তে শুষে নিল। অস্ত্রোপচারের পর যখন জানা গেল ক্যান্সার শুধু টিউমারেই সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের লসিকা গ্রন্থিতেও, তখন তাদের পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। চিকিৎসকরা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এই ক্যান্সারকে রুখতে হলে কেমোথেরাপি ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।

গর্ভাবস্থায় কেমোথেরাপি! এই শব্দগুলো অঙ্কিতার কানে যেন বিষের মতো বিঁধল। একদিকে নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদ, আর অন্যদিকে গর্ভের সন্তানের সুরক্ষার চিন্তা তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল। এর আগে তিনি কখনও শোনেননি যে কোনো গর্ভবতী মহিলাকে কেমোথেরাপি নিতে হয়েছে। তার পৃথিবীটা যেন এক গভীর অনিশ্চয়তার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিল।

এই কঠিন সময়ে দেবদূতের মতো তার পাশে এসে দাঁড়ালেন হাসপাতালের নার্স এবং চিকিৎসকেরা। অঙ্কিতার অনকোলজিস্ট তাকে বোঝালেন, মাতৃত্ব আর চিকিৎসা দুটোই একসাথে চলতে পারে। তারা তাকে আশ্বাস দিলেন যে প্রথম তিন মাস যেহেতু কেটে গেছে, তাই সেকেন্ড ট্রাইমস্টারে নির্দিষ্ট কিছু কেমোথেরাপি দেওয়া সম্ভব, যা গর্ভের সন্তানের জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। সেই ভরসার কথাগুলোই অঙ্কিতার মনে নতুন করে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিল।

শুরু হলো এক মায়ের অসম যুদ্ধ। একদিকে প্রথম ত্রৈমাসিকে হয়ে যাওয়া অস্ত্রোপচারের ধকল, আর অন্যদিকে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে শুরু হওয়া কেমোথেরাপির কষ্টকর পর্ব। কিন্তু অঙ্কিতার চোখে ছিল এক অদম্য স্বপ্ন—তার সন্তানকে এই পৃথিবীর আলো দেখানোর। প্রতিটি মুহূর্ত সে লড়াই করেছে, নিজের জন্য এবং তার সন্তানের জন্য।

অবশেষে সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন এলো। সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে অঙ্কিতা এক ফুটফুটে, স্বাস্থ্যবান পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। নির্ধারিত সময়েই তার জন্ম হয়েছিল এবং ওজনও ছিল স্বাভাবিক। সন্তানকে প্রথমবার কোলে নেওয়ার সেই স্বর্গীয় মুহূর্তে অঙ্কিতা আর রাহুলের সব যন্ত্রণা, সব কষ্ট যেন এক নিমিষে উবে গেল। তারা তাদের ছেলের নাম রাখল জীবন। জীবনকে বুকে জড়িয়ে ধরে তাদের মনে হলো, জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা তারা জিতে গেছে।

কিন্তু ভাগ্য তাদের জন্য আরও কঠিন পরীক্ষা সাজিয়ে রেখেছিল। জীবনের জন্মের মাত্র দুই মাস পর, অঙ্কিতার নিয়মিত চেকআপের স্ক্যান রিপোর্টে আবার খারাপ খবর এলো। তার শরীরের অন্য একটি লসিকা গ্রন্থিতে নতুন করে ক্যান্সার ফিরে এসেছে। চিকিৎসকেরা জানালেন, আবার অস্ত্রোপচার করতে হবে। এই খবরটা অঙ্কিতার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ার মতো ছিল। একদিকে ছোট্ট জীবনের দায়িত্ব, মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার আগেই তাকে হারানোর ভয়, আর অন্যদিকে নিজের শরীরের এই ভয়াবহ অবস্থা—সব মিলিয়ে তিনি যেন দিশেহারা হয়ে পড়লেন।

দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার সফল হলো, ক্যান্সার আক্রান্ত লসিকা গ্রন্থিটি শরীর থেকে বাদ দেওয়া গেল। কিন্তু এই অস্ত্রোপচারের পর অঙ্কিতাকে জীবনের সবচেয়ে বড় ত্যাগের মুখোমুখি হতে হলো। চিকিৎসকেরা তাকে জানালেন, তার পক্ষে আর কখনও মা হওয়া সম্ভব নয়। এই কথা শোনার পর অঙ্কিতা পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন। তার মনে হচ্ছিল, তার নারীত্ব, তার মাতৃত্বের স্বপ্ন—সবকিছুই যেন শেষ হয়ে গেল।

হতাশার সেই গভীরতম মুহূর্তে তার চিকিৎসক তার হাত ধরে বলেছিলেন, “আমি জানি এটা আপনার জন্য কতটা কঠিন। কিন্তু আপনি জীবনের জন্য যে লড়াইটা করেছেন, সেটা ভুলে যাবেন না। এখন আপনাকে নিজের জন্য লড়তে হবে, যাতে জীবন তার মাকে সুস্থভাবে ফিরে পায়। যা হারিয়ে গেছে তার জন্য শোক না করে, যা আপনার কাছে আছে, তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচুন।”

চিকিৎসকের এই কথাগুলো অঙ্কিতার মনে এক নতুন চেতনার জন্ম দিল। তিনি তার কান্নার কারণ না খুঁজে, তার হাসির কারণটিকে আঁকড়ে ধরলেন—তার সন্তান জীবন। তিনি বুঝতে পারলেন, তার বেঁচে থাকাটা কতটা জরুরি। এই উপলব্ধি তাকে নতুন করে বাঁচার শক্তি জোগাল, লড়াই করার সাহস দিল।

এরপর শুরু হলো রেডিয়েশন থেরাপি। এই দীর্ঘ এবং কষ্টকর চিকিৎসার পুরোটা সময় অঙ্কিতার মুখে ছিল এক অদ্ভুত শান্ত আর ইতিবাচক হাসি। তিনি ক্যান্সারকে তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে দেননি। তার এই অদম্য মানসিক শক্তি আর ইতিবাচক মনোভাব তার চারপাশের মানুষ, এমনকি তার চিকিৎসকদেরও অনুপ্রাণিত করত। তিনি নিজের জীবনকে রোগের সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলেননি, বরং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করেছেন।

অবশেষে, দীর্ঘ লড়াইয়ের পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অঙ্কিতা সম্পূর্ণ ক্যান্সার মুক্ত হলেন। আজ বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে, তার শরীরে ক্যান্সারের আর কোনো চিহ্ন নেই। চিকিৎসকেরা নিশ্চিত যে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং এক দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করবেন।

অঙ্কিতার জীবনযুদ্ধ আমাদের এটাই শেখায় যে, প্রতিকূলতা যতই অন্ধকার হোক না কেন, মনের গভীরে জ্বালিয়ে রাখা আশার একটি ছোট্ট প্রদীপই সেই অন্ধকার দূর করার জন্য যথেষ্ট। মাতৃত্বের শক্তি এক অদম্য শক্তি, যা একজন নারীকে যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করার সাহস জোগায়। অঙ্কিতার গল্প সেই সব মানুষদের জন্য এক অনুপ্রেরণা, যারা জীবনের কোনো না কোনো কঠিন লড়াই লড়ছেন। এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের শেষ কথা পরাজয় নয়, জীবনের শেষ কথা হলো আশা, ভালোবাসা এবং বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা।

 

Leave a Comment