আমাদের অদৃশ্য সঙ্গীঃ ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় মাইক্রোবায়োমের বিস্ময়কর ভূমিকা

আমাদের শরীরে যে কেবল আমাদের নিজস্ব কোষই বাস করে তা নয়, বরং রয়েছে কোটি কোটি অণুজীবের এক বিশাল জগৎ। এই অণুজীবদের সমষ্টিগতভাবে বলা হয় ‘মাইক্রোবায়োম’। এদের বেশিরভাগই আমাদের অন্ত্রে বাস করে এবং আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর এদের প্রভাব এতটাই গভীর যে বিজ্ঞানীরা এখন এদেরকে একটি স্বতন্ত্র অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছেন। হজমে সাহায্য করা থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা পর্যন্ত এদের কাজের পরিধি বিস্তৃত। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখা যাচ্ছে, এই মাইক্রোবায়োম ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের প্রতিরোধ এবং চিকিৎসাতেও এক বিপ্লবী ভূমিকা পালন করতে পারে।

মাইক্রোবায়োম কী এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?

আমাদের শরীরে, বিশেষ করে পরিপাকতন্ত্র এবং ত্বকে, ট্রিলিয়নেরও বেশি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাক বাস করে। এই সম্মিলিত অণুজীব জগতই হলো মাইক্রোবায়োম। মজার বিষয় হলো, আমাদের শরীরে মানুষের কোষের সংখ্যার প্রায় সমান সংখ্যক অণুজীবের কোষ রয়েছে। তাই বলা যেতে পারে, আমরা যতটা মানুষ, ঠিক ততটাই অণুজীব।

ঐতিহ্যগতভাবে, আমরা জেনে এসেছি যে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া খাবার হজম করতে এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন তৈরি করতে সাহায্য করে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে এর কার্যক্রম আরও অনেক ব্যাপক। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রায় ৭০ শতাংশই অন্ত্রে অবস্থিত এবং এই ব্যবস্থার সঠিক বিকাশে ও প্রশিক্ষণে মাইক্রোবায়োম সরাসরি ভূমিকা রাখে। এটি আমাদের শরীরকে শেখায় কোনগুলো বন্ধু অণুজীব এবং কোনগুলো শত্রু, যা ক্ষতিকর সংক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করে।

মাইক্রোবায়োম এবং ক্যান্সারের মধ্যে যোগসূত্র

বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্যহীনতা এবং ক্যান্সারের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই ভারসাম্যহীনতাকে ‘ডিসবায়োসিস’ বলা হয়, যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যেমন— অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ, সংক্রমণ বা অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার।

গবেষণায় দেখা গেছে, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের পরিবর্তন বিভিন্ন উপায়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে:

১. প্রদাহ সৃষ্টি: কিছু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রের ভেতরে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ তৈরি করতে পারে। এই লাগাতার প্রদাহ কোষের ক্ষতি করে এবং অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটিয়ে ক্যান্সারের পথ প্রশস্ত করতে পারে। কোলোরেক্টাল বা মলাশয়ের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা গেছে।

২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করা: একটি সুস্থ ও বৈচিত্র্যময় মাইক্রোবায়োম আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সচল ও শক্তিশালী রাখে। এই ব্যবস্থাটি শরীরের অস্বাভাবিক কোষগুলোকে শনাক্ত করে এবং ক্যান্সারে রূপান্তরিত হওয়ার আগেই ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্যহীনতা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়, ফলে ক্যান্সার কোষগুলো সহজে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।

৩. বিষাক্ত পদার্থ তৈরি: কিছু অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে যা আমাদের ডিএনএ-এর ক্ষতি করতে পারে এবং কোষের মিউটেশন বা পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। এই ধরনের পরিবর্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে যকৃত এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে, উপকারী ব্যাকটেরিয়ারা এই ক্ষতিকর পদার্থগুলোকে ভেঙে ফেলে আমাদের শরীরকে সুরক্ষা দেয়।

ক্যান্সারের চিকিৎসায় মাইক্রোবায়োমের প্রভাব

মাইক্রোবায়োমের ভূমিকা কেবল ক্যান্সার প্রতিরোধেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও এর প্রভাব আশ্চর্যজনক। বিশেষ করে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন ইমিউনোথেরাপির কার্যকারিতায় মাইক্রোবায়োমের বড় ভূমিকা রয়েছে।

ইমিউনোথেরাপি হলো এমন এক ধরনের চিকিৎসা যা রোগীর নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের গঠনই নির্ধারণ করে দিতে পারে একজন রোগীর শরীর ইমিউনোথেরাপিতে কতটা ভালোভাবে সাড়া দেবে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব রোগীদের অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্য বেশি, তারা ইমিউনোথেরাপিতে ভালো ফল পান। অন্যদিকে, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে যাদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্য কমে যায়, তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার কার্যকারিতা হ্রাস পায়।

একটি যুগান্তকারী গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ক্যান্সার থেকে সেরে ওঠা রোগীর মল থেকে অণুজীব সংগ্রহ করে চিকিৎসাধীন রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করেন, যাকে বলা হয় ফিকাল মাইক্রোবায়োটা ট্রান্সপ্ল্যান্ট (FMT)। এর ফলে দেখা গেছে যে, চিকিৎসায় সাড়া না দেওয়া রোগীদের শরীরও ইমিউনোথেরাপিতে ইতিবাচকভাবে সাড়া দিতে শুরু করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, সঠিক মাইক্রোবায়োম ক্যান্সার চিকিৎসার সাফল্যকে অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলতে পারে।

মাইক্রোবায়োমকে সুস্থ রাখার উপায়

যেহেতু আমাদের স্বাস্থ্য এবং ক্যান্সারের মতো রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মাইক্রোবায়োমের এত বড় ভূমিকা রয়েছে, তাই একে সুস্থ ও বৈচিত্র্যময় রাখা অত্যন্ত জরুরি। কিছু সাধারণ জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে আমরা আমাদের অন্ত্রের উপকারী বন্ধুদের যত্ন নিতে পারি:

  • ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার: ফল, সবজি, ডাল এবং শস্য জাতীয় খাবারে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। এই ফাইবার অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াদের প্রধান খাদ্য।
  • প্রোবায়োটিকস: দই, কিমচি, এবং অন্যান্য গাঁজানো খাবারে প্রচুর পরিমাণে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বা প্রোবায়োটিক থাকে, যা অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
  • প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা: অতিরিক্ত চিনি, লবণ এবং অস্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার অন্ত্রের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে তোলে, তাই এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত।
  • অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক নয়: অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি উপকারী ব্যাকটেরিয়াকেও ধ্বংস করে দেয়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা উচিত নয়।
  • নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুম: স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত শরীরচর্চা এবং পর্যাপ্ত ঘুম অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

ক্যান্সার এবং মাইক্রোবায়োমের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এর সম্ভাবনা অপরিসীম। বিজ্ঞানীরা এমন একটি ভবিষ্যৎ দেখছেন যেখানে রোগীর মাইক্রোবায়োম বিশ্লেষণ করে আগে থেকেই বলে দেওয়া সম্ভব হবে কোন চিকিৎসা তার জন্য সবচেয়ে কার্যকর হবে। এমনকি, নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়ার মিশ্রণ তৈরি করে ক্যাপসুলের মাধ্যমে রোগীকে খাইয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসার কার্যকারিতা বাড়ানো বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানোও সম্ভব হতে পারে।

আমাদের শরীরের ভেতরে বাস করা এই অদৃশ্য সঙ্গীরা নীরবে আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করে চলেছে। তাদের গুরুত্ব বুঝে যদি আমরা তাদের যত্ন নিই, তবে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা এক নতুন এবং শক্তিশালী অস্ত্র খুঁজে পাব। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে আমাদের অন্ত্রের বন্ধুদের ভালো রাখাটাই হয়তো ভবিষ্যতের সেরা স্বাস্থ্যবিমা।