ক্যানসারকে হার মানানোর নতুন স্বপ্নঃ লক্ষণ প্রকাশের ৩ বছর আগেই শনাক্তকরণ!

 

ভাবুন তো, যদি এমনটা হতো যে ক্যান্সার শরীরে বাসা বাঁধার অনেক আগেই, যখন তার কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায়নি, ঠিক তখনই আপনি জানতে পারলেন? শুনতে সায়েন্স ফিকশনের মতো মনে হলেও, বিজ্ঞানীরা কিন্তু এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন! জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সম্প্রতি এমন একটি যুগান্তকারী রক্ত পরীক্ষা নিয়ে কাজ করছেন, যা ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারে এর লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার প্রায় তিন বছর আগেই! অবিশ্বাস্য, তাই না?

আমরা সবাই জানি, ক্যান্সার যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে, চিকিৎসার সম্ভাবনা তত বেশি হয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময় ক্যান্সারের লক্ষণগুলো এত দেরিতে প্রকাশ পায় যে, ততক্ষণে হয়তো রোগ অনেকটাই ছড়িয়ে পড়েছে। আর ঠিক এই জায়গাতেই নতুন এই “multi-cancer early detection (MCED)” রক্ত পরীক্ষাটি গেম-চেঞ্জার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়া এই গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরেছে এবং সত্যিই, এটি ক্যান্সার রোগীদের জন্য এক নতুন আশার আলো নিয়ে এসেছে।

কী আছে এই নতুন রক্ত পরীক্ষায়?

আসলে, আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষ প্রতিনিয়ত ভেঙে যায় এবং নতুন কোষ তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ার সময়, কোষের ডিএনএ-র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ রক্তে মিশে যায়। ক্যান্সার কোষগুলো যখন অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, তখন তারা সাধারণ কোষের চেয়ে দ্রুত হারে ডিএনএ অংশ রক্তে ছাড়ে। এই MCED রক্ত পরীক্ষাটি মূলত রক্তের মধ্যে থাকা এই ক্যান্সার কোষের ডিএনএ (circulating tumor DNA বা ctDNA) চিহ্নিত করে। সহজ কথায়, আপনার রক্তে কোনো অস্বাভাবিক বা ক্যান্সারের চিহ্ন আছে কিনা, তা এই পরীক্ষা বলে দিতে পারে।

তিন বছর আগের পূর্বাভাস, এক নতুন দিগন্ত!

এই গবেষণার সবচেয়ে রোমাঞ্চকর দিকটি হলো, এর মাধ্যমে ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশের প্রায় ৩ বছর আগেই তা শনাক্ত করা সম্ভব। এর মানে হলো, একজন ব্যক্তি যখন সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন বলে মনে করছেন, তখনও তার শরীরে ক্যান্সারের আগমনী বার্তা এই পরীক্ষা ধরতে পারবে।

কল্পনা করুন, এটি কতো বড় একটি সুযোগ! তিন বছর সময় মানে চিকিৎসা শুরু করার জন্য অনেকটা বাড়তি সময় পাওয়া। এর ফলে ক্যান্সারের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা শুরু করা যাবে, যখন সেটি ছোট এবং স্থানীয় থাকে। তখন অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনের মতো চিকিৎসাগুলো অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে এবং রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও বহু গুণ বেড়ে যায়। এটি ঠিক যেন, ক্যান্সার নামক দুষ্টু শয়তানকে তার পরিকল্পনা শুরু করার আগেই ধরে ফেলা!

শুধু একটি ক্যান্সার নয়, অনেকগুলো!

এই পরীক্ষার আরেকটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য হলো, এটি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ধরনের ক্যান্সার নয়, বরং একাধিক ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের জন্য আলাদা আলাদা পরীক্ষা করার প্রয়োজন হবে না, একটি মাত্র রক্ত পরীক্ষাই সম্ভাব্য অনেকগুলো ক্যান্সার সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে। এটি বিশেষ করে সেইসব ক্যান্সারের জন্য খুব উপকারি হতে পারে, যেগুলোর জন্য বর্তমানে কোনো রুটিন স্ক্রিনিং পরীক্ষা নেই।

ভবিষ্যতের পথে…

যদিও এই গবেষণাটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং এটি সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে, তবুও এর সম্ভাবনা অপরিসীম।

এটি নিঃসন্দেহে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক বিশাল অগ্রগতি, যা ক্যান্সার মোকাবিলায় আমাদের হাতে এক নতুন এবং শক্তিশালী অস্ত্র তুলে দেবে। আমরা হয়তো এমন একটি ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে ক্যান্সার আর মরণব্যাধি হিসেবে থাকবে না, বরং সময় মতো শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এটি একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগে পরিণত হবে। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষকদের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম! তাদের এই আবিষ্কার লাখ লাখ মানুষের জীবনে নতুন আশার প্রদীপ জ্বালাতে চলেছে।

সত্যিই, এই খবরটি শুনে মনে হচ্ছে, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলাম।

Leave a Comment