ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। এই রোগটি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব এবং বিভিন্ন ভুল ধারণার কারণে অনেকেই আতঙ্কিত হন। এই লেখায় আমরা ক্যান্সার কী, কেন হয়, এর লক্ষণগুলো কী কী, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং এটি প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ক্যান্সার আসলে কী?
আমাদের শরীর অসংখ্য কোষ দিয়ে গঠিত। এই কোষগুলো একটি নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে বিভাজিত হয়ে নতুন কোষ তৈরি করে এবং পুরনো বা ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলো মারা যায়। কিন্তু যখন কিছু কোষের ডিএনএ-তে অস্বাভাবিক পরিবর্তন (মিউটেশন) ঘটে, তখন সেগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে শুরু করে। এই অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের ফলে শরীরের কোনো অংশে কোষের দলা বা পিণ্ড তৈরি হয়, যাকে টিউমার বলা হয়।
সব টিউমারই কিন্তু ক্যান্সার নয়। টিউমার দুই ধরনের হতে পারে:
- বিনাইন টিউমার (Benign Tumor): এই টিউমারগুলো ক্ষতিকারক নয়। এগুলো উৎপত্তিস্থলেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে না। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হলে এগুলো সাধারণত আর ফিরে আসে না।
- ম্যালিগন্যান্ট টিউমার (Malignant Tumor): এই টিউমারগুলোই ক্যান্সারযুক্ত। এগুলোর কোষ আশেপাশের টিস্যু বা কলার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। এই কোষগুলো রক্ত বা লসিকা নালীর মাধ্যমে শরীরের দূরবর্তী স্থানে ছড়িয়ে পড়ে নতুন টিউমার তৈরি করতে পারে। ছড়িয়ে পড়ার এই প্রক্রিয়াকে মেটাস্ট্যাসিস (Metastasis) বলা হয়। এই ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতার কারণেই ক্যান্সার এত বিপজ্জনক এবং এর চিকিৎসা করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
ক্যান্সার কেন হয়?
ক্যান্সার হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো একক কারণ নেই। বিভিন্ন কারণ সম্মিলিতভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রধান কারণগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- জীবনযাত্রা ও অভ্যাস:
- তামাক ও ধূমপান: ফুসফুস, মুখ, গলা, অগ্ন্যাশয়সহ প্রায় ৯০ শতাংশ ক্যান্সারের জন্য দায়ী ধূমপান। তামাক পাতা, জর্দা, পান-সুপারিও মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: প্রক্রিয়াজাত মাংস, অতিরিক্ত লবণ ও চিনিযুক্ত খাবার এবং কম আঁশযুক্ত খাবার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- অতিরিক্ত ওজন ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা: স্থূলতা এবং নিয়মিত ব্যায়ামের অভাব স্তন, কোলন এবং অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- মদ্যপান: অতিরিক্ত মদ্যপান লিভার, স্তন এবং অন্যান্য ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
- পরিবেশগত কারণ:
- রাসায়নিক পদার্থ: অ্যাসবেস্টস, বেনজিন, ফর্মালডিহাইডের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসা।
- তেজস্ক্রিয়তা: সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি (UV radiation) ত্বকের ক্যান্সারের প্রধান কারণ। এছাড়া চিকিৎসা বা পারমাণবিক দুর্ঘটনা থেকে সৃষ্ট আয়োনাইজিং রেডিয়েশনের সংস্পর্শও ঝুঁকি বাড়ায়।
- দূষণ: বায়ু দূষণও ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- বংশগত কারণ:
প্রায় ৫-১০% ক্যান্সার বংশগত বা জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। পরিবারের কোনো নিকটাত্মীয়ের (যেমন মা, বোন, খালা) স্তন, ডিম্বাশয় বা কোলন ক্যান্সার থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। - জীবাণু ও সংক্রমণ:
কিছু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। যেমন:- হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (HPV) জরায়ুমুখের ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
- হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
- এইচআইভি (HIV) ভাইরাসের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণ
ক্যান্সারের লক্ষণগুলো নির্ভর করে কোন অঙ্গে ক্যান্সার হয়েছে তার ওপর। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে যা দেখা দিলে সতর্ক হওয়া উচিত:
- অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস: কোনো কারণ ছাড়াই দ্রুত ওজন কমে যাওয়া।
- ক্রমাগত ক্লান্তি: বিশ্রাম নেওয়ার পরেও শরীর দুর্বল লাগা।
- দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা: শরীরের কোনো অংশে ক্রমাগত ব্যথা যা কোনো নির্দিষ্ট কারণে হচ্ছে না।
- ত্বকের পরিবর্তন: ত্বকের তিল বা আঁচিলের রঙ বা আকারে পরিবর্তন, নতুন কোনো মাংসপিণ্ড বা ঘা যা সহজে শুকায় না।
- খুসখুসে কাশি ও শ্বাসকষ্ট: দীর্ঘ সময় ধরে কাশি থাকা বা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
- মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন: ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া।
- অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ: মাসিকের সময় ছাড়াও যোনিপথে রক্তপাত, কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া ইত্যাদি।
- ঢোক গিলতে অসুবিধা বা হজমের সমস্যা: ক্রমাগত হজমের সমস্যা বা ঢোক গিলতে কষ্ট হওয়া।
এই লক্ষণগুলো থাকা মানেই ক্যান্সার নয়, তবে এগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার ধরা পড়লে তা নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
ক্যান্সারের প্রকারভেদ
শরীরের কোন কোষ বা টিস্যু থেকে ক্যান্সার শুরু হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে ক্যান্সারের নামকরণ করা হয়। ক্যান্সারের ১০০ টিরও বেশি প্রকারভেদ রয়েছে। প্রধান কয়েকটি প্রকার হলো:
- কার্সিনোমা (Carcinoma): সবচেয়ে সাধারণ এই ক্যান্সারটি ত্বক বা অভ্যন্তরীণ অঙ্গের আবরণী কলায় শুরু হয়। যেমন: স্তন, ফুসফুস, কোলন, প্রোস্টেট ক্যান্সার।
- সারকোমা (Sarcoma): এই ক্যান্সার হাড়, তরুণাস্থি, চর্বি, পেশী বা অন্যান্য সংযোগকারী টিস্যুতে তৈরি হয়।
- লিউকেমিয়া (Leukemia): এটি রক্তের ক্যান্সার, যা অস্থিমজ্জার রক্ত উৎপাদনকারী টিস্যু থেকে শুরু হয় এবং কঠিন টিউমার গঠন করে না।
- লিম্ফোমা (Lymphoma): এটি লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম বা লসিকা তন্ত্রের ক্যান্সার, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ।
বাংলাদেশে পুরুষদের মধ্যে ফুসফুস, খাদ্যনালী,পাকস্থলী, স্বরযন্ত্র এবং রেক্টাল ক্যান্সার এবং নারীদের মধ্যে স্তন, জরায়ুমুখ, ফুসফুস, মুখগহ্বর ও পাকস্থলী ক্যান্সার বেশি দেখা যায়।
ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা
ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে শারীরিক পরীক্ষা, বায়োপসি, বিভিন্ন ইমেজিং টেস্ট (এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই), এবং রক্ত পরীক্ষা।
ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে এর ধরন, পর্যায় (Stage) এবং রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ওপর। প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো হলো:
- অস্ত্রোপচার (Surgery): টিউমার এবং তার আশেপাশের কিছু টিস্যু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়। এটি ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ প্রাথমিক চিকিৎসা।
- কেমোথেরাপি (Chemotherapy): শক্তিশালী ওষুধ ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করা বা তাদের বৃদ্ধি বন্ধ করা হয়। এই ওষুধগুলো ইনজেকশন বা খাওয়ার মাধ্যমে দেওয়া হয়।
- রেডিয়েশন থেরাপি (Radiation Therapy): উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন রশ্মি (যেমন এক্স-রে বা গামা রে) ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করা হয়।
- ইমিউনোথেরাপি (Immunotherapy): এই পদ্ধতিতে শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করা হয়।
- টার্গেটেড থেরাপি (Targeted Therapy): এই ওষুধগুলো বিশেষভাবে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি এবং বিস্তারের জন্য দায়ী নির্দিষ্ট অণু বা জিনকে লক্ষ্য করে কাজ করে।
- হরমোন থেরাপি (Hormone Therapy): স্তন এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারের মতো হরমোন-নির্ভর ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা ব্যবহার করা হয়। এটি শরীরে হরমোনের উৎপাদন বন্ধ করে বা তার প্রভাবকে বাধা দিয়ে কাজ করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধে করণীয়
প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং কিছু অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব:
- তামাক ও মদ্যপান বর্জন: ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করা এবং মদ্যপান পরিহার করা ক্যান্সার প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: প্রচুর পরিমাণে ফল, শাকসবজি এবং আঁশযুক্ত খাবার খান। লাল ও প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়া কমান।
- নিয়মিত ব্যায়াম ও ওজন নিয়ন্ত্রণ: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন এবং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
- সূর্যের আলো থেকে সুরক্ষা: কড়া রোদ এড়িয়ে চলুন এবং সানস্ক্রিন ব্যবহার করে ত্বককে সুরক্ষিত রাখুন।
- টিকা গ্রহণ: হেপাটাইটিস বি এবং এইচপিভি-এর টিকা গ্রহণ করে লিভার ও জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বিশেষ করে যাদের পরিবারে ক্যান্সারের ইতিহাস আছে, তাদের নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ ও স্ক্রিনিং করানো উচিত।
উপসংহার
ক্যান্সার একটি মারাত্মক রোগ হলেও এটি অজেয় নয়। আধুনিক চিকিৎসার অগ্রগতির ফলে বর্তমানে অনেক ক্যান্সারেরই সফল চিকিৎসা সম্ভব। তবে এর জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করার মাধ্যমে আমরা এই রোগের বোঝা অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারি। মনে রাখতে হবে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।