ক্যান্সারের আত্মহনন!

 

ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রচলিত কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনের মতো চিকিৎসা প্রায়ই স্বাভাবিক কোষকেও আক্রান্ত করে, ফলে রোগীর শরীরে গঠনমূলক ক্ষতি ঘটে। কিন্তু সম্প্রতি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এমন এক নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন, যা টিউমার কোষগুলোর মধ্যে থাকা খারাপ প্রোটিনকে কাজে লাগিয়ে ক্যান্সার কোষগুলোকে “নিজেই ধ্বংস” করতে পারে—তবে স্বাভাবিক কোষগুলোকে স্পর্শ না করেই। 

কী প্রোটিন এই ‘BCL6’? কি সমস্যা করছে?

Diffuse large B‑cell lymphoma (DLBCL) নামে এক ধরণের ব্লাড ক্যান্সারে BCL6 নামক প্রোটিনটি প্রধান ভূমিকা পালন করে। সাধারণভাবে এই প্রোটিনটি নির্দিষ্ট জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ক্যান্সারে BCL6 এর মিউটেশন হয়ে যায়, এবং তা DNA-তে এমনভাবে বসে যায় যে ক্যান্সার কোষের নিজস্ব মৃত্যুর পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ক্যান্সার কোষ অমরত্বের পথে ধাবিত হয়—তার মৃত্যুর সংকেতগুলো রিপ্রেসড হয়ে বাইরে থাকে। 

কেমব্রিজ: “এখানেই আমাদেরকে লক্ষ্য করতে হবে”

গবেষক দল বুঝতে পেরেছে, BCL6 যেই মৃত্যুর জিন (apoptosis genes) ধরে রাখে, সেই নিয়ন্ত্রণটাই ভেঙে ফেললে ক্যান্সার কোষ নিজেই আত্মহনন শুরু করবে। সে লক্ষ্যই নিয়েই এই গবেষণার ভাবনা তৈরি হলো—কীভাবে BCL6-কে সেই মৃত্যুসংকেতের সাথে যুক্ত করা যায়? 

সমাধান: প্রোটিন প্রোক্সিসিটি বা “মলিকুলার গ্লু”

গবেষকরা “মলিকুলার গ্লু” (molecular glue) নামে এক ছোট অণু দিয়েছিলেন, যা BCL6 এবং CDK9 নামক আরেকটি প্রোটিনকে একত্রে টানা। CDK9 সাধারণত জিন অ্যাক্টিভেশন করতে সহায়তা করে—এবার এটির সাথে BCL6-এর যোগসূত্র তৈরি হলো। ফলে BCL6 বাধ্য হয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন মৃত্যুজিনগুলো চালু করে দেয়, যা ক্যান্সার কোষের নিজস্ব ধ্বংসে ইঙ্গিত দেয়। 

পরীক্ষার ফলাফল: চমকপ্রদ সফলতা

  • টিউমার কোষের পরীক্ষায়: “মলিকুলার গ্লু” প্রয়োগে ডি.এন.এ-র স্থানান্তরের মাধ্যমে টিউমার কোষেই লক্ষ্যভাগে মৃত্যুশণ সংকেত পৌঁছেছে, যা উল্লেখযোগ্য ভাবে ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করেছে। 
    স্বাস্থ্যকর জীবজন্তুতে পরীক্ষা: শরীরে প্রয়োগ করেও কোন ব্যাপক ক্ষতিকর পাশের প্রভাব পাওয়া যায়নি—তবে কিছু স্বাভাবিক B‑cell ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারণ তারা CDK9-এ নির্ভরশীল।
    বিস্তৃত ক্যান্সার কোষে পরীক্ষা: টেস্টে ৮৫৯টি বিভিন্ন ক্যান্সার কোষ ব্যবহার করে দেখা যায়, কেবল DLBCL অর্থাৎ diffuse large B‑cell lymphoma কোষগুলোতেই উচ্চ কার্যকারিতা—শুধু সেই এক ধরনের ক্যান্সার কোষ লক্ষ্য করে কাজ করছে। 

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

এই গবেষণা দেখালো যে, প্রসিদ্ধ অনকোজিনের ‍বিরূদ্ধে “অন” সংকেত বিলম্বে বিপরীত সংকেত হিসেবেও কাজে লাগানো যায়। গবেষকরা বলেন:

“You take something that the cancer is addicted to for its survival and you flip the script and make that be the very thing that kills it.” 

অর্থাৎ, ক্যান্সার কোষের জীবনদায়ী উপাদানটাকেই মৃত্যুর হিমস্রোত সৃষ্টি করতে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়া—ইনহিবিটার নয়, কিন্তু ইনভার্টার।

গবেষণা দল এখন জীবন্ত পরীক্ষায় DLBCL মডেলযুক্ত মাউস-এ পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথম দিকের ফলাফল ইতিবাচক; এবার মনোযোগ চিকিৎসার কাঠামো, ডোজ-নির্ভরতা ও বিক্রম পরিচালনায়। 

স্টার্টআপ এবং ভবিষ্যৎ সোপান

স্ট্যানফোর্ড ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের দুই বিশিষ্ট গবেষক—Gerald Crabtree ও Nathanael Gray—এই প্রযুক্তিকে ব্যবসায় পরিণত করেছেন “Shenandoah Therapeutics” নামের একটি বায়োটেক স্টার্ট‑আপের মাধ্যমে। এই প্রতিষ্ঠানটি এখন সংশ্লিষ্ট অণুগুলোর ক্লিনিক্যাল প্রস্তুতির কাজে জোর দিচ্ছে। ধাপে ধাপে তারা এই প্রযুক্তিকে বহু ধরনের ক্যান্সারে প্রয়োগ করার পরিকল্পনা তৈরি করছে—বিশেষ করে Ras অনকোজেনের মতো জটিল লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে। 

উপসংহার

  • নতুন দিগন্তে ক্যান্সার চিকিৎসা: প্রচলিত থেরাপির বাইরে এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে ক্যান্সার কোষদের নিজস্ব “অন্তঃকরণ” প্রবণতা ব্যবহার করে তাদের ধ্বংসের চাল-প্রণালী।

  • নির্দিষ্টাকৃত টার্গেট: এটি কেবল DLBCL-এ কার্যকর, অন্য সাধারণ ক্যান্সার কোষকে প্রভাবিত করে না।

  • নির্দিষ্টতা ও কম টক্সিসিটি: স্বাভাবিক কোষকে আপেক্ষিক নিরাপদে রেখে ক্যান্সার কোষকে ধ্বংসের লক্ষ্য করে।

ভবিষ্যতে বিস্তৃতি: মাউস পরীক্ষার সফলতার পরই এটি অন্যান্য ক্যান্সার টাইপে প্রয়োগযোগ্য এবং বহুসংখ্যক অনকোজিনের বিরুদ্ধে পরীক্ষামূলক প্রয়াস শুরু হতে পারে।

Leave a Comment