ক্যান্সার – নামটিই আতঙ্কের। প্রচলিত চিকিৎসা যেমন কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন অনেক সময় জীবন বাঁচায়, আবার অনেক সময় রোগীর সুস্থ কোষকেও ধ্বংস করে দিয়ে ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। তাই বিজ্ঞানীরা সবসময় খুঁজছেন এমন এক চিকিৎসা, যা কেবল ক্যান্সার কোষকে আঘাত করবে, অথচ সুস্থ কোষ থাকবে অক্ষত।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা সেই আশার আলো দেখাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যারোলিনা (MUSC)-এর হলিংস ক্যান্সার সেন্টারের গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন LCL768 নামের এক পরীক্ষামূলক ওষুধ। এটি মূলত লক্ষ্য করে ক্যান্সার কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া—যা কোষের শক্তি তৈরির কারখানা।
শক্তির উৎসে আঘাত
LCL768 হলো সিরামিড নামের একটি ফ্যাট অণুর কৃত্রিম রূপ। এই অণুটি স্বাভাবিকভাবে শরীরে থাকে এবং কোষের টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক ক্যান্সারে সিরামিডের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কম থাকে, যা টিউমারকে আরও আক্রমণাত্মক করে তোলে।
গবেষকরা দেখেছেন, LCL768 ক্যান্সার কোষে বিশেষ ধরনের সিরামিড (C18-সিরামিড) বাড়িয়ে দেয়। তখন শুরু হয় মাইটোফ্যাজি প্রক্রিয়া, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত মাইটোকন্ড্রিয়া ভেঙে ফেলা হয়। মাইটোকন্ড্রিয়া হারালে ক্যান্সার কোষ শক্তিহীন হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মারা পড়ে।
দ্বৈত আক্রমণ
এখানেই শেষ নয়। LCL768 ক্যান্সার কোষের শক্তিচক্রে থাকা ফিউমারেট নামের একটি অপরিহার্য অণুকেও ব্লক করে দেয়। ফলে কোষের বিপাকীয় প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে।
অর্থাৎ, একদিকে মাইটোকন্ড্রিয়া ধ্বংস, অন্যদিকে শক্তি উৎপাদনের রাস্তা বন্ধ – এই দ্বৈত আক্রমণ ক্যান্সার কোষকে একেবারে অসহায় করে ফেলে।
পরীক্ষার ফল
গবেষণা দলটি মাউস মডেল এবং রোগীর টিস্যু থেকে তৈরি ল্যাব-গ্রোন টিউমারে LCL768 পরীক্ষা করেছে। ফলাফলে দেখা গেছে—
- C18-সিরামিড বেড়েছে
- মাইটোফ্যাজি সক্রিয় হয়েছে
- ক্যান্সার কোষের শক্তি উৎপাদন ভেঙে পড়েছে
- টিউমারের বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, যখন কোষকে বাড়তি ফিউমারেট দেওয়া হলো, তখন ওষুধটির প্রভাব প্রায় উল্টে গেল। এতে প্রমাণিত হলো—LCL768 আসলেই ক্যান্সার কোষের দুর্বল বিপাকীয় পথকে টার্গেট করছে।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
🔹 প্রচলিত কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনের মতো এ ওষুধ সব কোষকে নির্বিচারে আক্রমণ করে না।
🔹 সুস্থ কোষ তুলনামূলকভাবে অক্ষত থাকে, ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম হওয়ার সম্ভাবনা।
🔹 ক্যান্সার চিকিৎসায় এটি একেবারে নতুন কৌশল – কোষের ভেতরের দুর্বলতাকে কাজে লাগানো।
সামনে কী অপেক্ষা করছে?
এখনও LCL768 মানুষের উপর ব্যবহার হয়নি, অর্থাৎ এটি প্রাক-ক্লিনিক্যাল ধাপেই রয়েছে। তবে প্রাথমিক ফলাফল এতটাই শক্তিশালী যে গবেষকরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোয়, তবে ভবিষ্যতে LCL768 হয়ে উঠতে পারে এমন এক চিকিৎসা, যা প্রচলিত কেমোথেরাপির কঠিন বিকল্পকে অনেকটা সরিয়ে দেবে—রোগীদের দেবে নতুন আশা, কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দীর্ঘ জীবন।
এক কথায়, বিজ্ঞানীরা যেন ক্যান্সার কোষের গোপন সুইচ খুঁজে পেয়েছেন। সেটি বন্ধ করে দিলে কোষের শক্তির উৎসই নিভে যায়। ভবিষ্যতে এই আবিষ্কার হয়তো ক্যান্সার চিকিৎসায় এক নতুন অধ্যায় রচনা করবে।