ক্যান্সার চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্তঃ সাইবারনাইফ রেডিওসার্জারি

ক্যান্সার চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্ত: সাইবারনাইফ রেডিওসার্জারি

ক্যান্সার, এই নামটি শুনলেই আমাদের মনে ভয় এবং অনিশ্চয়তা এসে ভর করে। তবে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এই ভয়কে জয় করার জন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পথ খুলে দিচ্ছে। এমনই এক যুগান্তকারী প্রযুক্তির নাম হলো সাইবারনাইফ রেডিওসার্জারি (CyberKnife Radiosurgery)। এটি এমন এক চিকিৎসা পদ্ধতি যা কোনো রকম কাটাছেঁড়া ছাড়াই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে টিউমার কোষকে ধ্বংস করতে সক্ষম। বিশেষ করে প্রোস্টেট ক্যান্সার, যা পুরুষদের মধ্যে অন্যতম সাধারণ একটি ক্যান্সার, তার চিকিৎসায় সাইবারনাইফ এক নতুন আশার আলো দেখিয়েছে।

সাইবারনাইফ আসলে কী?

সহজ ভাষায়, সাইবারনাইফ হলো একটি অত্যাধুনিক রোবোটিক রেডিওসার্জারি সিস্টেম। এর নামের সাথে “নাইফ” বা ছুরি শব্দটি থাকলেও এর সাথে কোনোপ্রকার অস্ত্রোপচারের সম্পর্ক নেই। এটি আসলে একটি ক্ষুদ্র লিনিয়ার এক্সিলারেটর (বিকিরণ রশ্মি তৈরির যন্ত্র), যা একটি অত্যন্ত নমনীয় রোবোটিক হাতের উপর বসানো থাকে। এই রোবোটিক হাতটি মানুষের হাতের মতোই বিভিন্ন দিক থেকে ঘুরতে পারে, যার ফলে শত শত বিভিন্ন কোণ থেকে টিউমারের উপর সুনির্দিষ্টভাবে বিকিরণ রশ্মি প্রয়োগ করা সম্ভব হয়।

কার্যপ্রণালী: নির্ভুলতা যেখানে মূল শক্তি

সাইবারনাইফ প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর অবিশ্বাস্য নির্ভুলতা। চিকিৎসা শুরু করার আগে সিটি (CT) বা এমআরআই (MRI) স্ক্যানের মাধ্যমে টিউমারের একটি ত্রিমাত্রিক (3D) ছবি তৈরি করা হয়। এরপর একদল বিশেষজ্ঞ, যার মধ্যে থাকেন রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, নিউরোসার্জন এবং চিকিৎসা পদার্থবিদ, তারা মিলে একটি ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরি করেন।

চিকিৎসার সময়, এই কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত রোবোটিক হাতটি রোগীর চারপাশে ঘুরে টিউমারটিকে লক্ষ্য করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিকিরণ রশ্মি নিক্ষেপ করে। এর রিয়েল-টাইম ইমেজ গাইডেন্স সিস্টেম রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস বা সামান্য নড়াচড়ার সাথে সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, যা নিশ্চিত করে যে বিকিরণ শুধুমাত্র টিউমারের উপরেই পড়ছে। এর ফলে টিউমারের আশেপাশের সুস্থ কোষ, যেমন প্রোস্টেট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে মূত্রাশয় বা মলদ্বার, প্রায় কোনো ক্ষতি ছাড়াই সুরক্ষিত থাকে।

রোগীর অভিজ্ঞতা: আরামদায়ক ও দ্রুত আরোগ্য

প্রচলিত ক্যান্সার চিকিৎসার তুলনায় সাইবারনাইফ রোগীদের জন্য অনেক বেশি আরামদায়ক। এর কিছু অনবদ্য সুবিধা হলো:

  • বিনা কর্তনে চিকিৎসা: এই পদ্ধতিতে কোনো কাটাছেঁড়া বা সেলাইয়ের প্রয়োজন হয় না, ফলে অ্যানেস্থেশিয়ারও দরকার পড়ে না।

  • ব্যথাহীন পদ্ধতি: চিকিৎসা চলাকালীন রোগী কোনো ব্যথা অনুভব করেন না।

  • স্বল্প সময়ের চিকিৎসা: যেখানে প্রচলিত রেডিয়েশন থেরাপিতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে, সাইবারনাইফ চিকিৎসা মাত্র এক থেকে পাঁচটি সেশনের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। প্রতিটি সেশন সাধারণত ৩০ থেকে ৯০ মিনিট স্থায়ী হয়।

  • ন্যূনতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: এর নির্ভুলতার কারণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যেমন ত্বকের জ্বালা বা চুল পড়া, অত্যন্ত কম। প্রোস্টেট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের পর যেসব ঝুঁকি (যেমন असंयम বা পুরুষত্বহীনতা) থাকে, সাইবারনাইফের ক্ষেত্রে তা অনেকটাই কম।

  • দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরা: এটি একটি আউটপেশেন্ট পদ্ধতি, অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তি থাকার প্রয়োজন হয় না। চিকিৎসার পর রোগীরা খুব দ্রুত, এমনকি এক সপ্তাহের মধ্যেই তাদের দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে পারেন।

শুধু প্রোস্টেটেই সীমাবদ্ধ নয়

সাইবারনাইফ প্রযুক্তি শুধুমাত্র প্রোস্টেট ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় না। এর কার্যকারিতা মস্তিষ্ক, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, যকৃত, মেরুদণ্ড এবং এমনকি স্তন ক্যান্সারের মতো বিভিন্ন ধরণের টিউমারের ক্ষেত্রেও প্রমাণিত হয়েছে। যে সমস্ত টিউমার অস্ত্রোপচারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বা শরীরের জটিল অংশে অবস্থিত, সেগুলোর জন্য সাইবারনাইফ একটি অত্যন্ত কার্যকর বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে।

সঠিক চিকিৎসা কেন্দ্র নির্বাচন

যেকোনো উন্নত প্রযুক্তির সফল প্রয়োগের জন্য অভিজ্ঞ এবং দক্ষ বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন। সাইবারনাইফ চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এমন একটি কেন্দ্র বেছে নেওয়া উচিত যেখানে বহু-বিভাগীয় বিশেষজ্ঞদের একটি দল (Multi-disciplinary team) একসঙ্গে কাজ করে এবং রোগীর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করে। একজন ভালো চিকিৎসক রোগীকে সমস্ত বিকল্প, যেমন সার্জারি, ক্রায়োথেরাপি বা অ্যাক্টিভ সার্ভিলেন্স, সম্পর্কে অবহিত করেন এবং রোগীর সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।

পরিশেষে বলা যায়, সাইবারনাইফ রেডিওসার্জারি ক্যান্সার চিকিৎসার জগতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এর নির্ভুলতা, কার্যকারিতা এবং রোগীর জন্য আরামদায়ক পদ্ধতি এটিকে অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত চিকিৎসার চেয়ে উন্নততর বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এই প্রযুক্তি ক্যান্সারে আক্রান্ত বহু মানুষের জীবনে নতুন করে বাঁচার আশা জাগাচ্ছে।

 

 

Leave a Comment