ক্যান্সার চিকিৎসার নতুন নায়কঃ ইমিউনোথেরাপির শক্তি

ক্যান্সার চিকিৎসায় ইমিউনোথেরাপি এক নতুন আশা জাগানো অধ্যায় উন্মোচন করেছে। ২০২২ সালে এ নিয়ে প্রথম যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, তার সাম্প্রতিকতম ফলাফল সম্প্রতি সামনে এসেছে। মেমোরিয়াল স্লোন কেটারিং ক্যান্সার সেন্টারের ডা. আন্দ্রেয়া সেরসি এবং তাঁর টিমের সাম্প্রতিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দেখিয়েছে যে, ক্যান্সার রোগীদের বড় একটি অংশকে কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন বা জটিল অস্ত্রোপচার ছাড়াই সুস্থ করা সম্ভব হতে পারে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী রোগীদের মধ্যে প্রায় ৮০% মানুষ আর কোনো অতিরিক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন পড়েনি—শুধুমাত্র ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে।

 

ইমিউনোথেরাপি কীভাবে কাজ করে?

ইমিউনোথেরাপি হলো এমন একধরনের চিকিৎসা যা রোগীর নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে সক্রিয় করে তোলে। সাধারণত, ক্যান্সার কোষগুলো শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখে। এরা প্রতিরোধ কোষের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় বা “ব্রেক” চাপিয়ে রাখে। ইমিউনোথেরাপি সেই ব্রেক সরিয়ে দেয়, ফলে রোগ প্রতিরোধ কোষগুলো সহজেই ক্যান্সার কোষ আক্রমণ করে ধ্বংস করতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি শরীরের জন্য তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর এবং দীর্ঘমেয়াদে রোগীর শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখতে সহায়ক।

 

চমকপ্রদ ক্লিনিক্যাল ফলাফল

সাম্প্রতিক ট্রায়ালে ১০৩ জন রোগীর ওপর এই চিকিৎসা পরীক্ষা করা হয়েছে। পূর্বে শুধুমাত্র প্রাথমিক রেক্টাল ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে এর প্রয়োগ সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা খাদ্যনালী, পাকস্থলী এবং ইউরোথেলিয়াল ক্যান্সারসহ অন্যান্য সলিড টিউমারেও সফল প্রমাণিত হয়েছে। যেমন, ব্রুস নোলমায়ারের কিডনি ক্যান্সার মাত্র ছয় মাসের ইমিউনোথেরাপির পর সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যায়। চিকিৎসকরা যখন স্ক্যান রিপোর্টে কোনো টিউমার খুঁজে পাননি, তখন তিনি নিজেই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন।

আরেকটি আশ্চর্যজনক উদাহরণ হলো, রেক্টাল ক্যান্সারের ১৮ জন রোগীর মধ্যে ১৮ জনই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন—কোনো কেমোথেরাপি বা অস্ত্রোপচার ছাড়াই। এই সাফল্য ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

 

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সুবিধা

প্রচলিত কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন চিকিৎসা প্রায়শই রোগীর শরীরে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে—চুল পড়া, দুর্বলতা, সংক্রমণের ঝুঁকি এবং মানসিক অবসাদ। ইমিউনোথেরাপি এসবের তুলনায় অনেক বেশি সহনশীল ও মানবদেহের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। এমনকি যেসব রোগীর ক্যান্সার পুরোপুরি নির্মূল না হয়, তাদের ক্ষেত্রেও টিউমারের আকার উল্লেখযোগ্যভাবে ছোট হয়ে আসে। ফলে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে ছোট পরিসরে অস্ত্রোপচার করা যায়, যা রোগীর শরীরের উপর কম চাপ সৃষ্টি করে।

 

ক্যান্সার গবেষণায় নতুন দিগন্ত

ক্যান্সার চিকিৎসার ইতিহাসে ইমিউনোথেরাপি কোনো একদিনে আবিষ্কৃত হয়নি। শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে গবেষকরা মানবদেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ক্যান্সার মোকাবিলার চেষ্টা করেছেন। আজকের এই সাফল্য এসেছে ধাপে ধাপে অগ্রগতি ও সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক উন্নতির মাধ্যমে। ডা. সেরসি ও তাঁর দল এই ক্ষেত্রে এক নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছেন।

তবে এই ধরনের অগ্রগামী গবেষণা অব্যাহত রাখতে পর্যাপ্ত তহবিল ও সহায়তা প্রয়োজন। বিশেষত তরুণ গবেষকদের কাজকে এগিয়ে নিতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও অর্থায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি উদাহরণ হলো কেলি স্পিল, যিনি দুই বছর আগে ইমিউনোথেরাপির সুফল পেয়েছিলেন এবং এখন একটি সুখী পারিবারিক জীবনযাপন করছেন।

 

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বর্তমানে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইমিউনোথেরাপি শুধু ক্যান্সার চিকিৎসায় নয়, রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীরা কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশনের মতো কষ্টকর ধাপ এড়িয়ে আরও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন। গবেষকরা আশাবাদী যে, আগামী দিনে এই প্রযুক্তি আরও পরিপূর্ণ হয়ে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসার মূলধারায় স্থান করে নেবে।

উপসংহার:
 

ইমিউনোথেরাপি আধুনিক ক্যান্সার চিকিৎসার এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। এটি শুধু রোগ নিরাময়ের প্রক্রিয়াই বদলে দিচ্ছে না, বরং রোগীর জন্য জীবনমানের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করছে। যদি পর্যাপ্ত গবেষণা ও অর্থায়ন অব্যাহত থাকে, তবে ভবিষ্যতে ক্যান্সার মোকাবেলায় ইমিউনোথেরাপি হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর ও কম ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি।

Leave a Comment