ক্যান্সার থেকে কিভাবে মৃত্যু এড়ানো যায়?

ক্যান্সার থেকে কিভাবে মৃত্যু এড়ানো যায়? এই প্রশ্নটি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। আমেরিকার প্রথম ঘাতক হৃদরোগকে পরাজিত করার পর, ডক্টর ডিন অর্নিশ এবার দ্বিতীয় ঘাতক, অর্থাৎ ক্যান্সারের দিকে মনোনিবেশ করেন। তাঁর গবেষণা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে একটি সম্পূর্ণ উদ্ভিজ্জ খাদ্য এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা ক্যান্সারের অগ্রগতিকে কেবল থামিয়েই দেয় না, বরং তাকে বিপরীত দিকে চালিত করতেও সক্ষম।

ডক্টর অর্নিশ এবং তাঁর সহকর্মীরা প্রস্টেট ক্যান্সারের উপর একটি যুগান্তকারী গবেষণা করেন। তাঁরা দেখেন, যারা আমেরিকানদের মতো গতানুগতিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করেন, তাদের রক্ত ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধিতে প্রায় ৯% বাধা দিতে পারে। কিন্তু যখন একদল ব্যক্তিকে এক বছরের জন্য সম্পূর্ণ উদ্ভিজ্জ খাদ্যাভ্যাসের উপর রাখা হয়, তখন তাদের রক্তের ক্ষমতা আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে যায়। এই ব্যক্তিদের রক্ত ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করতে প্রায় আট গুণ বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই গবেষণাটি ছিল পুরুষদের প্রধান ঘাতক প্রস্টেট ক্যান্সারের উপর।

এরপর গবেষকরা একই পরীক্ষাটি মহিলাদের প্রধান ঘাতক, স্তন ক্যান্সারের কোষের উপর করতে চাইলেন। কিন্তু তাঁরা এক বছর অপেক্ষা করতে রাজি ছিলেন না, কারণ প্রতিদিন বহু মহিলা এই রোগে মারা যাচ্ছেন। তাই তাঁরা মাত্র দুই সপ্তাহের একটি সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা চালান। এই পরীক্ষায় দেখা যায়, ১৪ দিন উদ্ভিজ্জ খাদ্য গ্রহণের পরেই মহিলাদের রক্ত স্তন ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে অসাধারণ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে। পরীক্ষা শুরুর আগে, ক্যান্সার কোষগুলো ১০০% গতিতে বাড়ছিল, কিন্তু মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই তাদের বৃদ্ধি নাটকীয়ভাবে কমে যায়। গবেষকরা দেখেন, অংশগ্রহণকারী মহিলাদের রক্তপ্রবাহ ক্যান্সার কোষের জন্য এতটাই প্রতিকূল হয়ে উঠেছে যে, তাদের শরীর নিজে থেকেই ক্যান্সার কোষগুলিকে পরিষ্কার করতে শুরু করেছে।

এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় “অ্যাপোপটোসিস” বা  কোষের মৃত্যু। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার ফলে শরীর ক্যান্সার কোষগুলোকে পুনরায় প্রোগ্রাম করতে সক্ষম হয়, যার ফলে তারা সময়ের আগেই মারা যায়। “TUNEL ইমেজিং” নামে একটি পদ্ধতির মাধ্যমে এই কোষের মৃত্যু পরিমাপ করা হয়। যেখানে দেখা যায়, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পর মহিলাদের রক্তে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে গেছে।

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, এই পরিবর্তনের পেছনে কি কেবলই খাদ্যাভ্যাস দায়ী, নাকি ব্যায়ামেরও কোনো ভূমিকা আছে? কারণ অংশগ্রহণকারীদের প্রতিদিন ৩০ থেকে ৬০ মিনিট হাঁটতে বলা হয়েছিল। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গবেষকরা একটি তুলনামূলক পরীক্ষা চালান। একদল ব্যক্তি, যারা গড়ে ১৪ বছর ধরে উদ্ভিজ্জ খাদ্য গ্রহণ করছিলেন এবং হালকা ব্যায়াম করতেন, তাদের রক্তের ক্যান্সার প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে এমন একদল ব্যক্তির তুলনা করা হয়, যারা ১৪ বছর ধরে আমেরিকান খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করেছেন কিন্তু প্রতিদিন কঠোর ব্যায়াম করেছেন। ফলাফল ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। যদিও ব্যায়াম নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে কিছুটা সাহায্য করে, কিন্তু ৫,০০০ ঘণ্টার কঠোর ব্যায়ামও উদ্ভিজ্জ খাদ্যাভ্যাসের ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি।

এর পেছনের মূল কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা “ইনসুলিন-লাইক গ্রোথ ফ্যাক্টর-১” (IGF-1) নামক একটি হরমোনকে চিহ্নিত করেছেন। প্রাণীজ প্রোটিন—যেমন মাংস, ডিম এবং দুগ্ধজাত খাবার—শরীরে IGF-1-এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা ক্যান্সারের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে। একটি পরীক্ষায় দেখা যায়, যখন উদ্ভিজ্জ খাদ্য গ্রহণকারী ব্যক্তির রক্ত থেকে IGF-1 হরমোন কৃত্রিমভাবে যোগ করা হয়, তখন রক্তের ক্যান্সাররোধী ক্ষমতা প্রায় পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এটি প্রমাণ করে যে, প্রাণীজ প্রোটিন বর্জন করার ফলেই শরীর ক্যান্সার প্রতিরোধী হয়ে ওঠে।

একটি বৃহৎ গবেষণায় দেখা গেছে, মধ্যবয়সী ব্যক্তিরা যারা উচ্চ প্রাণীজ প্রোটিনযুক্ত খাবার খান, তাদের ক্যান্সার থেকে মৃত্যুর ঝুঁকি চারগুণ বেশি। এই ঝুঁকি ধূমপানের ঝুঁকির সাথে তুলনীয়। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের প্রেস রিলিজে লেখে, “আপনি যে চিকেন উইং খাচ্ছেন, তা একটি সিগারেটের মতোই মারাত্মক হতে পারে।”

এর প্রতিক্রিয়ায় কিছু পুষ্টিবিজ্ঞানী বলেন যে, মাংস এবং দুধের সাথে ধূমপানের তুলনা করা বিপজ্জনক, কারণ এতে ধূমপায়ীরা ভাবতে পারে যে ধূমপান ছাড়া ততটা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এই যুক্তি ঠিক নয়। এটি অনেকটা এমন যে, “ছুরিকাঘাত নিয়ে চিন্তা করো না, কারণ গুলিবিদ্ধ হওয়া আরও খারাপ।” আসল কথা হলো, আমাদের উভয় ঝুঁকি থেকেই দূরে থাকা উচিত। দুটি ঝুঁকি মিলে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। দিন শেষে প্রশ্ন একটাই: আমরা আমাদের শরীরে কোন ধরনের রক্ত চাই? এমন রক্ত যা ক্যান্সার কোষের সামনে নতজানু হয়, নাকি এমন রক্ত যা শরীরের প্রতিটি কোণায় পৌঁছে ক্যান্সারকে থামিয়ে দিতে পারে? উত্তরটি আমাদের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেই নিহিত।