ক্যান্সার শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। তবে সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ মোকাবেলা করা সম্ভব। ক্যান্সার চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলোর একটি হলো ‘ক্যান্সার স্টেজিং’। সহজ ভাষায়, স্টেজিং হলো ক্যান্সারের বিস্তৃতি বা পর্যায় নির্ণয়ের একটি পদ্ধতি। এর মাধ্যমে চিকিৎসক বুঝতে পারেন ক্যান্সারটি শরীরের ঠিক কোন জায়গায় আছে, এর আকার কতটুকু এবং এটি শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়েছে কি না। এই স্টেজিংয়ের ওপর ভিত্তি করেই ক্যান্সারের চিকিৎসার পরিকল্পনা তৈরি করা হয় এবং রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কেও একটি ধারণা পাওয়া যায়।
ক্যান্সার স্টেজিং কেন জরুরি?
ক্যান্সার স্টেজিং চিকিৎসকদের জন্য একটি রোডম্যাপের মতো কাজ করে। এর মাধ্যমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা যায়:
- সঠিক চিকিৎসা নির্বাচন: ক্যান্সারের পর্যায় অনুযায়ী চিকিৎসার ধরন বদলে যায়। যেমন, প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সারের জন্য সার্জারি বা রেডিয়েশন থেরাপি যথেষ্ট হতে পারে। কিন্তু ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি বা অন্যান্য ওষুধের প্রয়োজন হয়।
- প্রোগনোসিস বা পূর্বাভাস: স্টেজিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসক রোগীর আরোগ্যের সম্ভাবনা বা প্রোগনোসিস সম্পর্কে একটি ধারণা দিতে পারেন। কোন পর্যায়ের ক্যান্সারে রোগীর সেরে ওঠার হার কেমন, তা গবেষণার মাধ্যমে অনেকটাই জানা সম্ভব হয়েছে।
- ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল: নতুন কোনো চিকিৎসা পদ্ধতির কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট পর্যায়ের রোগীদের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়। স্টেজিং এখানে সঠিক রোগী নির্বাচনে সাহায্য করে।
- তথ্যের আদান-প্রদান: বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকরা যাতে একই মানদণ্ডে ক্যান্সারের অবস্থা বুঝতে পারেন এবং নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারেন, সেজন্য স্টেজিং একটি সাধারণ ভাষা হিসেবে কাজ করে।
স্টেজিং কীভাবে করা হয়?
ক্যান্সারের পর্যায় নির্ণয়ের জন্য বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
- শারীরিক পরীক্ষা: চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন।
- ইমেজিং টেস্ট: এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, এবং পেট স্ক্যানের মাধ্যমে শরীরের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবি তুলে টিউমারের আকার ও অবস্থান দেখা হয়।
- বায়োপসি: আক্রান্ত স্থানের কোষ বা টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করে ক্যান্সারের ধরন ও গ্রেড নির্ণয় করা হয়।
- রক্ত পরীক্ষা: কিছু ক্ষেত্রে ‘টিউমার মার্কার’ পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সারের উপস্থিতি ও অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
এই পরীক্ষাগুলোর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ক্যান্সারের পর্যায় নির্ধারণ করা হয়।
টিএনএম (TNM) স্টেজিং সিস্টেম
ক্যান্সার স্টেজিংয়ের জন্য সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি হলো টিএনএম (TNM) সিস্টেম। এখানে:
- T (Tumor): এটি মূল টিউমারের আকার এবং অবস্থান বোঝায়। T-এর পাশে ১ থেকে ৪ পর্যন্ত সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। সংখ্যা যত বেশি, টিউমারের আকার তত বড় বা সেটি তত বেশি বিস্তৃত।
- N (Node): এটি নির্দেশ করে ক্যান্সার পার্শ্ববর্তী লসিকা গ্রন্থি বা লিম্ফ নোডে ছড়িয়েছে কি না। N0 মানে লিম্ফ নোডে ক্যান্সার ছড়ায়নি। N1, N2 বা N3 দিয়ে বোঝানো হয় ক্যান্সার লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর পরিমাণ কতটুকু।
- M (Metastasis): এটি দিয়ে বোঝানো হয় ক্যান্সার শরীরের দূরবর্তী কোনো অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে কি না। M0 মানে ক্যান্সার অন্য কোথাও ছড়ায়নি, আর M1 মানে এটি মেটাস্টেসিস করেছে, অর্থাৎ শরীরের অন্য কোনো অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে।
এই তিনটি প্যারামিটারের তথ্যের সমন্বয়ে ক্যান্সারের পর্যায় নির্ধারণ করা হয়।
ক্যান্সারের বিভিন্ন পর্যায় (Stages)
টিএনএম সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করে ক্যান্সারকে সাধারণত কয়েকটি সংখ্যাভিত্তিক পর্যায়ে ভাগ করা হয়।
- পর্যায় ০ (Stage 0): এটিকে ‘ইন সিটু’ (in situ) ক্যান্সারও বলা হয়। এক্ষেত্রে অস্বাভাবিক কোষগুলো শুধুমাত্র তাদের উৎপত্তিস্থলেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং আশেপাশের টিস্যুতে ছড়ায়নি। এই পর্যায়ের ক্যান্সার সাধারণত সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।
- পর্যায় ১ (Stage I): এই পর্যায়ে টিউমারটি আকারে ছোট থাকে এবং এটি শুধুমাত্র উৎপত্তিস্থলেই সীমাবদ্ধ থাকে। লিম্ফ নোড বা অন্য কোনো অঙ্গে ছড়ায় না।
- পর্যায় ২ ও ৩ (Stage II & III): এই পর্যায়গুলোতে টিউমার আকারে বড় হয় এবং আশেপাশের টিস্যু ও লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তবে শরীরের দূরবর্তী কোনো অঙ্গে ছড়ায় না।
- পর্যায় ৪ (Stage IV): এটি ক্যান্সারের সবচেয়ে অগ্রসর পর্যায়। এই পর্যায়ে ক্যান্সার উৎপত্তিস্থল থেকে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের দূরবর্তী এক বা একাধিক অঙ্গে, যেমন—লিভার, ফুসফুস, মস্তিষ্ক বা হাড়ে বিস্তার লাভ করে। একে মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সারও বলা হয়।
অনেক সময় এই সংখ্যাগুলোর পাশে A, B বা C অক্ষর ব্যবহার করে পর্যায়গুলোকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে ভাগ করা হয়।
ক্যান্সারের গ্রেড (Grade)
স্টেজিংয়ের পাশাপাশি ক্যান্সারের ‘গ্রেড’ নির্ণয়ও খুব জরুরি। গ্রেডিংয়ের মাধ্যমে মাইক্রোস্কোপের নিচে ক্যান্সারের কোষগুলো দেখতে কেমন, তা নির্ধারণ করা হয়। স্বাভাবিক কোষের সাথে এর যত বেশি পার্থক্য থাকে, গ্রেড তত বেশি হয় এবং ক্যান্সার তত দ্রুত ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।
- গ্রেড ১ (Low-grade): কোষগুলো দেখতে প্রায় স্বাভাবিক কোষের মতো এবং এগুলো ধীরে ধীরে বাড়ে।
- গ্রেড ২ (Intermediate-grade): কোষগুলো কিছুটা অস্বাভাবিক।
- গ্রেড ৩ ও ৪ (High-grade): কোষগুলো দেখতে অনেক বেশি অস্বাভাবিক এবং খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় ও ছড়িয়ে পড়ে।
পরিশেষে বলা যায়, ক্যান্সার স্টেজিং এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি অপরিহার্য অংশ। এটি রোগীকে তাঁর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেয় এবং চিকিৎসকদের সঠিক পথে এগোতে সাহায্য করে। ক্যান্সারের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে ভয় না পেয়ে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো অত্যন্ত জরুরি। কারণ, প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয় করা গেলে তা নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।