প্রবাদ আছে, “আপনি যা খান, আপনি তাই”। এই কথাটি কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সত্য। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বলছে, আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসই অনেকাংশে নির্ধারণ করে দিতে পারে এই মারাত্মক রোগটির ঝুঁকি। চিনিযুক্ত পানীয় এবং লাল মাংস যেখানে এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, সেখানে কিছু সাধারণ খাবার ও মশলা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই প্রাকৃতিক উপাদানগুলো অনেক সময় ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধের চেয়েও বেশি কার্যকর, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী হতে পারে।
ঝুঁকি বাড়ায় যে সব খাবার
কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকির সাথে লাল মাংস এবং প্রক্রিয়াজাত মাংসের গভীর সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রক্রিয়াজাত মাংসকে গ্রুপ-১ কার্সিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সসেজ, বেকনের মতো খাবারে ব্যবহৃত রাসায়নিক সংরক্ষক এবং উচ্চ তাপে রান্না করার পদ্ধতি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। একইভাবে, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয় এবং পরিশোধিত শর্করা গ্রহণ স্থূলতা এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়, যা কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। এই খাবারগুলো শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে পারে।
প্রতিরোধের প্রাকৃতিক বর্ম
তবে আশার কথা হলো, রান্নাঘরে থাকা সাধারণ কিছু উপাদানই হতে পারে আপনার সুরক্ষার বর্ম। এদের মধ্যে অন্যতম হলো হলুদ।
- হলুদ: হলুদের মধ্যে থাকা কারকিউমিন নামক যৌগটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বা প্রদাহরোধী উপাদান। গবেষণা বলছে, কারকিউমিন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিকে দমন করতে পারে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও হলুদকে মহৌষধি হিসেবে গণ্য করা হয়।
- পালং শাক: টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির এক নতুন গবেষণা অনুযায়ী, নিয়মিত পালং শাক খেলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। পালং শাকে থাকা বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
- ফলমূল: আপেল, কলা, ব্লুবেরি এবং রাস্পবেরির মতো ফলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইবার থাকে। এই উপাদানগুলো শরীর থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ বের করে দেয় এবং ক্যান্সার কোষের গঠন প্রতিরোধ করে।
- বাদাম: আমন্ড, কাজু এবং ম্যাকadamia বাদামের মতো বাদাম ফাইবার, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং ভিটামিন ই-এর মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উৎস। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত বাদাম খান তাদের ক্যান্সার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি কমে যায়।
- গোটা শস্য, বিনস ও লেগুমস: এই খাবারগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা অন্ত্র পরিষ্কার রাখতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। এর ফলে অন্ত্রের ভেতর বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শ কম হয় এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস পায়। ডাল, ছোলা, মসুরের মতো খাবারে থাকা রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে পুষ্টি জোগায়।
- মাছ: ফ্যাটি ফিশ বা চর্বিযুক্ত মাছ যেমন স্যামন, ম্যাকেরেল ও সার্ডিনে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা শরীরের প্রদাহ কমাতে অত্যন্ত কার্যকরী। ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটির একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে সমস্ত মহিলারা সপ্তাহে তিনবার মাছ খান, তাদের কোলন পলিপ এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ৩৩ শতাংশ কমে যায়। এই ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিও বিলম্বিত করতে পারে।
জীবনযাত্রায় পরিবর্তন
শুধুমাত্র সঠিক খাদ্যাভ্যাসই নয়, একটি সুস্থ জীবনযাত্রাও কোলোরেক্টাল ক্যান্সার প্রতিরোধে অপরিহার্য। নিয়মিত শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা, ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করা এই রোগের ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অল্প বয়স থেকেই যদি এই স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো গড়ে তোলা যায়, তাহলে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব।
পরিশেষে বলা যায়, কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা শুরু হতে পারে আপনার খাবার প্লেট থেকেই। প্রক্রিয়াজাত খাবার ও অতিরিক্ত চিনিকে বিদায় জানিয়ে হলুদ, পালং শাক, ফল, বাদাম এবং মাছের মতো প্রাকৃতিক খাবারকে আপন করে নিলে, আপনি কেবল একটি মারাত্মক রোগকেই প্রতিরোধ করবেন না, বরং একটি সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনের পথে এগিয়ে যাবেন।