আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার বর্তমানে ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন আশা জাগাচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের এক কিশোরী বেস এডিটিং নামে এক নতুন পদ্ধতিতে লিউকেমিয়া থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে। এই চিকিৎসা পদ্ধতি মূলত মানুষের ডিএনএ-তে সূক্ষ্ম পরিবর্তন এনে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নতুনভাবে সক্রিয় করে তোলে। চিকিৎসকদের মতে, এটি ক্যান্সার চিকিৎসায় এক অভূতপূর্ব অগ্রগতি যা ভবিষ্যতের চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্রই বদলে দিতে পারে।
বেস এডিটিং কীভাবে কাজ করে?
আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে থাকা ডিএনএ হলো এক বিশাল নির্দেশিকা, যেখানে অক্ষরগুলোর বিন্যাস আমাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। এই ডিএনএ-তে ছোট্ট কোনো ত্রুটি বা “ভুল বানান” থেকেও জন্ম নিতে পারে গুরুতর রোগ যেমন ক্যান্সার। বেস এডিটিং প্রযুক্তি হলো একধরনের মলিকিউলার মেশিন, যা ডিএনএ-এর নির্দিষ্ট একটি অক্ষর পরিবর্তন করে সঠিক অক্ষরে রূপান্তরিত করতে পারে। ফলে জিনগত ত্রুটির কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো সংশোধন করা সম্ভব হয়।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড লিউ, যিনি এই প্রযুক্তির অন্যতম উদ্ভাবক, জানিয়েছেন যে বেস এডিটিংয়ের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধক কোষ—বিশেষ করে টি সেল—কে নতুনভাবে প্রোগ্রাম করা হয়। এই কোষগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে তারা ক্যান্সার কোষ খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়, অথচ সুস্থ কোষে কোনো ক্ষতি না হয়।
অ্যালিসার গল্প: ব্যর্থতা থেকে সফলতার পথে
লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত কিশোরী অ্যালিসার ওপর সবধরনের প্রচলিত চিকিৎসা ব্যর্থ হয়েছিল। চিকিৎসকরা যখন তার সুস্থ হওয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন, তখন শেষ অবলম্বন হিসেবে বেছে নেওয়া হয় এই নতুন বেস এডিটিং পদ্ধতি। অ্যালিসা নিজে এই ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষামূলক চিকিৎসার জন্য সম্মতি দেয়। কয়েক মাসের মধ্যেই চমকপ্রদ ফলাফল দেখা যায়—অ্যালিসার শরীরে আর কোনো ক্যান্সার শনাক্ত হয়নি। যদিও চিকিৎসকরা এখনো তাকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখছেন, তবুও এই সফলতা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।
সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা
ক্যান্সার হলো এমন এক রোগ যা ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে আমাদের ওষুধ ও চিকিৎসা পদ্ধতিকে ফাঁকি দিতে চায়। তাই চিকিৎসকরা সরাসরি “ক্যান্সারের স্থায়ী চিকিৎসা” শব্দটি ব্যবহার করতে সতর্ক থাকেন। তবে বেস এডিটিং শুধু ক্যান্সার নয়, ভবিষ্যতে অনেক জটিল জিনগত রোগ যেমন সিকেল সেল অ্যানিমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, এমনকি কিছু হৃদরোগও নিরাময়ের সম্ভাবনা তৈরি করছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে চারটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন রোগে এই প্রযুক্তি প্রয়োগের পরীক্ষা চলছে।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর নির্ভুলতা। এই প্রযুক্তি ডিএনএ-তে অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিবর্তন আনে, ফলে অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। যদিও এখনো এটি ব্যয়সাপেক্ষ এবং বিশেষায়িত গবেষণাগার নির্ভর, ভবিষ্যতে প্রযুক্তি সহজলভ্য হলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এক নতুন অধ্যায় সূচিত হবে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বেস এডিটিংয়ের মাধ্যমে ক্যান্সার নিরাময়ের যাত্রা মাত্র শুরু হয়েছে। এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রয়ে গেছে—এই চিকিৎসা কতদিন স্থায়ী ফল দিতে পারে, একাধিকবার প্রয়োগ করলে তার প্রভাব কী হবে, কিংবা এটি অন্যান্য জটিল রোগে সমান কার্যকর হবে কি না। তাছাড়া নৈতিক দিক থেকেও ডিএনএ পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, যা নিয়ে গভীর গবেষণা ও নীতিনির্ধারণ প্রয়োজন।
উপসংহার
জিন থেরাপির এই নতুন অধ্যায় প্রমাণ করে যে চিকিৎসাবিজ্ঞান কীভাবে ধীরে ধীরে কোষ ও ডিএনএ স্তরে রোগের মূল উৎস খুঁজে বের করছে এবং তা সংশোধন করছে। অ্যালিসার সুস্থ হওয়া শুধু একটি ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়; এটি বিশ্বজুড়ে কোটি রোগীর জন্য আশার আলো। ভবিষ্যতে বেস এডিটিং এবং অনুরূপ জিন থেরাপির উন্নতি ক্যান্সারসহ অনেক মরণব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হতে পারে। এই আবিষ্কার আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিজ্ঞান ও মানবতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়।