ক্যান্সার একটি জটিল রোগ, যা বয়স, পরিবেশ, জীবনযাত্রা এবং পারিবারিক ইতিহাসের মতো বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কিছু পরিবারে ক্যান্সার বেশি দেখা যায়, যা আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায় যে, ক্যান্সার কি বংশগত রোগ? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের জিনের মধ্যে।
জিন এবং ক্যান্সার: সম্পর্কটা ঠিক কোথায়?
আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে প্রায় ২০,০০০ জিন রয়েছে। এই জিনগুলো আমাদের শরীরকে নির্দেশ দেয় কিভাবে কাজ করতে হবে। যেমন – চোখের রঙ, চুলের রঙ বা উচ্চতা নির্ধারণ করা। কিছু জিন আমাদের শরীরকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়।
যখন কোনো জিনের গঠনে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটে, তখন তাকে মিউটেশন বলা হয়। এই পরিবর্তনের ফলে জিনটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, মানুষের জীবনকালে বিভিন্ন কারণে জিনে মিউটেশন ঘটে। যদি ক্যান্সার প্রতিরোধকারী কোনো জিনে এই ধরনের পরিবর্তন হয়, তাহলে কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি শুরু হতে পারে, যা ক্যান্সারে রূপ নেয়। এভাবেই বেশিরভাগ ক্যান্সার হয়ে থাকে।
বিরল কিছু ক্ষেত্রে, এই জিন মিউটেশন উত্তরাধিকারসূত্রে বা বংশগতভাবে পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। যখন ক্যান্সার প্রতিরোধকারী কোনো জিনে মিউটেশন উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায়, তখন তাকে বংশগত ক্যান্সার বলা হয়। এই ধরনের ক্ষেত্রে, বাবা বা মায়ের থেকে সন্তানের মধ্যে এই পরিবর্তিত জিন সঞ্চারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০ শতাংশ।
তবে, উত্তরাধিকার সূত্রে পরিবর্তিত জিন পেলেই যে একজন ব্যক্তির ক্যান্সার হবেই, তা নিশ্চিত নয়। এর মানে হলো, সাধারণ মানুষের তুলনায় তার নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বংশগত ক্যান্সারের লক্ষণ
কিছু লক্ষণ নির্দেশ করে যে একটি পরিবারে বংশগত ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- অল্প বয়সে ক্যান্সার নির্ণয়।
- একই ব্যক্তির একাধিক ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া।
- পরিবারে একই ধরনের ক্যান্সারে (যেমন স্তন বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার) একাধিক সদস্যের আক্রান্ত হওয়া।
- বিরল ধরনের ক্যান্সার দেখা দেওয়া।
পরিবারের সদস্যদের ক্যান্সারের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বংশগত ক্যান্সারের ঝুঁকি মূল্যায়ন করা হয়। এই ঝুঁকিকে সাধারণত নিম্ন, মাঝারি বা উচ্চ—এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়।
- নিম্ন ঝুঁকি: পরিবারে যদি সাধারণ ক্যান্সার (যেমন স্তন বা প্রোস্টেট ক্যান্সার) বেশি বয়সে (সাধারণত ৫০ বছরের পরে) দেখা যায়, তবে ঝুঁকি কম বলে মনে করা হয়।
- মাঝারি ঝুঁকি: যখন পরিবারে দুই বা ততোধিক নিকটাত্মীয়ের অল্প বয়সে (৫০ বছরের আগে) স্তন বা কোলন ক্যান্সারের মতো রোগ নির্ণয় করা হয়, তখন ঝুঁকি মাঝারি বলে ধরা হয়। নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠী, যেমন আশকেনাজি ইহুদিদের মধ্যে বংশগত ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বেশি থাকে।
- উচ্চ ঝুঁকি: যদি পরিবারের একাধিক প্রজন্মে, অল্প বয়সে এবং বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কিত ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে, তবে ঝুঁকি উচ্চ বলে বিবেচিত হয়।
জেনেটিক টেস্টিং: ঝুঁকি নির্ণয়ের উপায়
জেনেটিক টেস্টিং হলো একটি চিকিৎসা পরীক্ষা, যার মাধ্যমে ডিএনএ-তে নির্দিষ্ট কোনো পরিবর্তন বা মিউটেশন শনাক্ত করা হয়। এটি সাধারণত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির ক্যান্সারের ঝুঁকি এবং তার পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
জেনেটিক পরীক্ষার ফলাফল তিন ধরনের হতে পারে:
- নেতিবাচক (Negative): এর মানে হলো, পরীক্ষা করা জিনগুলোতে কোনো ক্ষতিকারক মিউটেশন পাওয়া যায়নি। এটি বংশগত ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়, কিন্তু পুরোপুরি দূর করে না।
- অনিশ্চিত (Uncertain): যখন জিনে এমন কোনো পরিবর্তন পাওয়া যায়, যার সঙ্গে ক্যান্সারের ঝুঁকির সম্পর্ক বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়, তখন তাকে “অনিশ্চিত তাৎপর্যের রূপ” বা Variant of Uncertain Significance (VUS) বলা হয়।
- ইতিবাচক (Positive): এর মানে হলো, ক্যান্সার প্রতিরোধকারী জিনে একটি ক্ষতিকারক মিউটেশন পাওয়া গেছে। এই ফলাফল নির্দিষ্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং এর ভিত্তিতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বা চিকিৎসার পরিকল্পনা করা যেতে পারে।
একটি ইতিবাচক ফলাফল পেলে চিকিৎসকেরা বিশেষ স্ক্রিনিং, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন। এছাড়াও, পরিবারের অন্য সদস্যরাও এই নির্দিষ্ট মিউটেশনের জন্য পরীক্ষা করাতে পারেন, যা তাদের নিজেদের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করে।
জেনেটিক্স এবং ক্যান্সার সম্পর্কিত তথ্য বেশ জটিল হতে পারে। তাই এই বিষয়ে জেনেটিক কাউন্সেলরের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। তারা পরীক্ষার ফলাফল বুঝতে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, জেনেটিক্স ক্যান্সারের এই জটিল ধাঁধার একটি অংশ মাত্র, সম্পূর্ণ চিত্র নয়।