ক্যান্সার আধুনিক বিশ্বের এক ভয়াবহ ব্যাধির নাম। এই রোগের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশনের মতো গতানুগতিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু দশক ধরে। তবে এইসব পদ্ধতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক এবং তা রোগীর শরীরকে দুর্বল করে দেয়। সম্প্রতি, চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক নতুন এবং যুগান্তকারী পদ্ধতির সন্ধান পেয়েছেন, যার নাম ‘টার্গেটেড আলফা থেরাপি’ (Targeted Alpha Therapy)। এই অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতিটি শুধু ক্যান্সার কোষকেই লক্ষ্যবস্তু করে ধ্বংস করে, সুস্থ কোষের ওপর এর প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই থেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চলেছে।
টার্গেটেড আলফা থেরাপি কীভাবে কাজ করে?
টার্গেটেড আলফা থেরাপি হলো এক ধরনের আণবিক বিকিরণ চিকিৎসা। এই পদ্ধতিতে একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপকে বিশেষ এক ধরনের অণুর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। এই অণুগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যা শুধুমাত্র ক্যান্সার কোষকে শনাক্ত করতে এবং তার সাথে আবদ্ধ হতে পারে। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এই অণু-আইসোটোপের মিশ্রণ শরীরে প্রবেশ করানোর পর, তা রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্যান্সার কোষ খুঁজে বের করে।
যখন এই অণুটি ক্যান্সার কোষের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন এর সঙ্গে থাকা আইসোটোপটি আলফা কণা নামক শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় কণা নির্গত করে। এই আলফা কণা ক্যান্সার কোষের ডিএনএ (DNA)-কে ছিন্নভিন্ন করে দেয়, যার ফলে কোষটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতির কার্যকারিতাকে তুলনা করেছেন একটি শক্তিশালী বোমার সঙ্গে, যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। প্রচলিত রেডিয়েশন থেরাপি যেখানে অনেকটা কাঁচের দোকানে ঢিল ছোঁড়ার মতো, সেখানে টার্গেটেড আলফা থেরাপি যেন এক নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ, যা শুধুমাত্র শত্রুকে বিনাশ করে।
কানাডায় যুগান্তকারী ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল
কানাডার লন্ডন, অন্টারিওর হেলথ সায়েন্সেস সেন্টারে (LHSC) বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই যুগান্তকারী পদ্ধতির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। গিলবার্ট আমারাল, যিনি ২০১১ সাল থেকে নিউরোএন্ডোক্রাইন ক্যান্সারে ভুগছেন, তিনি কানাডায় প্রথম রোগীদের মধ্যে একজন যিনি অ্যাক্টিনিয়াম-২২৫ (Actinium-225) নামক তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে এই চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমার (NETs) হলো এক ধরনের বিরল ক্যান্সার যা শরীরের হরমোন উৎপাদনকারী কোষকে প্রভাবিত করে।
এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নেতৃত্বে রয়েছেন লন্ডন হেলথ সায়েন্সেস সেন্টার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (LHSCRI) গবেষক এবং নিউক্লিয়ার অনকোলজিস্ট ডঃ ডেভিড লেডলি। তিনি এবং তাঁর দল এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির কার্যকারিতা এবং সুরক্ষা মূল্যায়ন করছেন। ডঃ লেডলির মতে, এই থেরাপি রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার পাশাপাশি আয়ু বাড়াতেও সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ট্রায়ালটি ২০২৬ সাল নাগাদ শেষ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমার এবং চিকিৎসার গুরুত্ব
নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমারগুলো প্রায়শই দেরিতে শনাক্ত হয়, কারণ এর লক্ষণগুলো অন্যান্য সাধারণ রোগের মতো হতে পারে। এই টিউমারগুলোর প্রকোপ বিশ্বজুড়ে বাড়ছে, এবং একবার তা শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়লে (মেটাস্ট্যাটিক), তার চিকিৎসা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে, টার্গেটেড আলফা থেরাপির মতো নতুন এবং কার্যকর চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ২০টিরও বেশি টার্গেটেড আলফা থেরাপির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। গবেষকরা অগ্ন্যাশয়, প্রোস্টেট এবং স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও এই পদ্ধতির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছেন। যদিও এই থেরাপি এখনও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বাইরে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পায়নি, তবে বেশ কয়েকটি চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অনুমোদন পেতে পারে।
এই চিকিৎসা সফল হলে, রোগীদের আর কষ্টদায়ক কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনের জন্য হাসপাতালে দিনের পর দিন কাটাতে হবে না। একটি ইঞ্জেকশনের মাধ্যমেই এই চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব, যা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর চাপ কমাবে এবং রোগীদের জন্য এক নতুন আশার আলো হয়ে উঠবে। গিলবার্ট আমারালের মতো অগণিত ক্যান্সার রোগীর কাছে এই নতুন থেরাপি শুধু বেঁচে থাকার একটি নতুন আশাই নয়, বরং উন্নত জীবনযাত্রার এক নতুন প্রতিশ্রুতি।