স্তন ক্যান্সারের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার (টিএনবিসি) একটি বিশেষ এবং অপেক্ষাকৃত আক্রমণাত্মক রূপ। সমস্ত স্তন ক্যান্সারের প্রায় ১৫ শতাংশই এই প্রকৃতির। এই ধরনের ক্যান্সার দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখায়। তবে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে এর সফল মোকাবেলা করা সম্ভব।
ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার কী?
আমাদের শরীরের কোষের উপরিভাগে কিছু গ্রাহক বা রিসেপ্টর থাকে যা কোষের বৃদ্ধি এবং বিভাজনকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান রিসেপ্টর হলো – ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর, প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর এবং হিউম্যান এপিডার্মাল গ্রোথ ফ্যাক্টর রিসেপ্টর ২ (HER2)। যখন কোনো ক্যান্সার কোষে এই তিনটি রিসেপ্টরের একটিও উপস্থিত থাকে না, তখন তাকে ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার বলা হয়। এই রিসেপ্টরগুলির অনুপস্থিতির কারণেই প্রচলিত হরমোনাল থেরাপি বা টার্গেটেড থেরাপি এই ক্যান্সারের চিকিৎসায় অকার্যকর হয়।
কাদের ঝুঁকি বেশি?
যদিও টিএনবিসি যে কোনো বয়সেই হতে পারে, তবে কিছু ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি বেশি থাকে। যেমন:
- বয়স: সাধারণত ৪০ বছরের কম বয়সী মহিলাদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
- জিনগত কারণ: BRCA1 জিনের গঠনগত ত্রুটি বা মিউটেশন টিএনবিসি-র একটি অন্যতম প্রধান কারণ। যাদের পরিবারে স্তন বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ইতিহাস রয়েছে, তাদের এই জিনগত ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা বেশি।
- জাতি: আফ্রিকান-আমেরিকান এবং হিস্পানিক বংশোদ্ভূত মহিলাদের মধ্যে এই ক্যান্সারের হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
লক্ষণ ও উপসর্গ
ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণগুলি অন্যান্য স্তন ক্যান্সারের মতোই হয়ে থাকে। সাধারণ কিছু লক্ষণের মধ্যে রয়েছে:
- স্তনে নতুন কোনো পিন্ড বা চাকা অনুভব করা।
- স্তনের আকার বা আকৃতির পরিবর্তন।
- স্তনের ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, পুরু হয়ে যাওয়া বা কমলার খোসার মতো ছোট ছোট গর্ত দেখা দেওয়া।
- স্তনবৃন্ত থেকে দুধ ছাড়া অন্য কোনো ধরনের তরল নিঃসৃত হওয়া বা স্তনবৃন্ত ভিতরের দিকে ঢুকে যাওয়া।
- স্তনে বা স্তনবৃন্তে ব্যথা অনুভব করা।
- বগলের নিচে বা কন্ঠার হাড়ের কাছে লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠা।
এই ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
রোগ নির্ণয়
সাধারণত টিস্যু পরীক্ষার (বায়োপসি) মাধ্যমে টিএনবিসি নির্ণয় করা হয়। স্তনের সন্দেহজনক অংশ থেকে একটি ছোট টিস্যুর নমুনা নিয়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমেই ক্যান্সার কোষের উপস্থিতি এবং সেগুলিতে উল্লিখিত তিনটি রিসেপ্টরের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি
যেহেতু টিএনবিসি-তে হরমোন বা টার্গেটেড থেরাপির সুযোগ নেই, তাই এর প্রধান চিকিৎসা হলো কেমোথেরাপি। কেমোথেরাপির মাধ্যমে দ্রুত বিভাজিত হওয়া ক্যান্সার কোষগুলিকে ধ্বংস করা হয়। চিকিৎসার অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে:
- অস্ত্রোপচার: টিউমারের আকার এবং অবস্থান অনুযায়ী, টিউমার ও তার চারপাশের কিছু অংশ অপসারণ (লাম্পেকটমি) অথবা সম্পূর্ণ স্তন অপসারণ (মাস্টেকটমি) করা হয়।
- বিকিরণ চিকিৎসা (রেডিয়েশন থেরাপি): অস্ত্রোপচারের পর অবশিষ্ট ক্যান্সার কোষগুলিকে ধ্বংস করতে এবং রোগের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি কমাতে রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভিত্তিক চিকিৎসা (ইমিউনোথেরাপি): কিছু ক্ষেত্রে, শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষকে আক্রমণ করার জন্য ইমিউনোথেরাপি একটি নতুন এবং কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অনেক সময় অস্ত্রোপচারের আগে কেমোথেরাপি (নিয়োঅ্যাডজুভেন্ট কেমোথেরাপি) দেওয়া হয়। এর ফলে টিউমারের আকার ছোট হয়ে আসে, যা অস্ত্রোপচারকে আরও সহজ করে তোলে।
আরোগ্য লাভের হার
ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সারের পূর্বাভাস মূলত রোগের পর্যায়ের উপর নির্ভর করে। যদি ক্যান্সার শুধুমাত্র স্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে (স্থানীয় পর্যায়), তবে পাঁচ বছর বেঁচে থাকার হার প্রায় ৯১ শতাংশ। কিন্তু যদি ক্যান্সার শরীরের দূরবর্তী অংশে ছড়িয়ে পড়ে, তবে এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তাই, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সবশেষে বলা যায়, ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার নিঃসন্দেহে একটি গুরুতর রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এবং সময়মতো চিকিৎসার মাধ্যমে বহু রোগীই এখন সুস্থ জীবনযাপন করছেন। সচেতনতা এবং সঠিক সময়ে পদক্ষেপই এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মূল হাতিয়ার।