ডেইরি প্রোডাক্ট বা দুগ্ধজাত খাবার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী না ক্ষতিকর, এই বিতর্ক বেশ পুরনো। একদিকে যেমন এগুলিকে ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের চমৎকার উৎস হিসেবে দেখা হয়, তেমনই অন্যদিকে অতিরিক্ত ফ্যাট, লবণ এবং প্রদাহ সৃষ্টির কারণ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। তবে সাম্প্রতিক কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা এই ধারণাকে নতুনভাবে ভাবতে সাহায্য করছে। কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বিশেষ কিছু দুগ্ধজাত খাবার ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে এবং একই সাথে শরীরের ফ্যাট কমাতেও ভূমিকা রাখতে পারে।
ডেইরি প্রোডাক্টের ইতিবাচক দিকঃ ক্যান্সারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার?
দই এবং প্রোবায়োটিকসঃ
যেসব দুগ্ধজাত খাবারকে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে মনে করা হচ্ছে, তার মধ্যে দই অন্যতম। দই একটি ফার্মেন্টেড বা গাঁজানো খাবার, যা প্রোবায়োটিক বা উপকারী ব্যাকটেরিয়ায় সমৃদ্ধ। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো, যেমন ল্যাকটোব্যাসিলাস এবং বিফিডোব্যাকটেরিয়াম, অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, অন্ত্রের সুস্থ মাইক্রোবায়োম প্রদাহ কমাতে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে, যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত দই খেলে কোলোরেক্টাল বা অন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা যায়, যারা সপ্তাহে অন্তত দুই দিন দই খান, তাদের বিফিডোব্যাকটেরিয়াম-পজিটিভ টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ২০ শতাংশ কমে যায়। বাংলাদেশ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, যিনি দই নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনি জানান যে অর্গানিক দই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া, ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতেও দইয়ের সম্ভাব্য ভূমিকার কথা কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে।
ক্যালসিয়ামের ভূমিকা:
দুগ্ধজাত খাবার ক্যালসিয়ামের একটি বড় উৎস। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যালসিয়াম অন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। ক্যালসিয়াম অন্ত্রের কোষগুলোকে সুরক্ষা দেয় এবং ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করতে পারে। নিয়মিত দুধ ও দই খাওয়ার অভ্যাস কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে বলে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা মনে করেন।
বিতর্ক ও ঝুঁকির দিকগুলো
ডেইরি প্রোডাক্ট নিয়ে সব খবরই ইতিবাচক নয়। কিছু ক্ষেত্রে এর ঝুঁকির দিকও রয়েছে, যা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এখনও গবেষণা চলছে।
প্রোস্টেট ক্যান্সারঃ
কিছু পর্যবেক্ষণমূলক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবারের খুব বেশি পরিমাণে গ্রহণ পুরুষদের মধ্যে প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। এর একটি সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দুধের মধ্যে থাকা ইনসুলিন-লাইক গ্রোথ ফ্যাক্টর-১ (IGF-1) কে দায়ী করা হয়। এই উপাদানটি কোষের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে, যা অনিয়ন্ত্রিত হলে ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
অন্যান্য ক্যান্সারের সঙ্গে সম্পর্কঃ
স্তন ক্যান্সারের সঙ্গে দুগ্ধজাত খাবারের সম্পর্ক নিয়ে মিশ্র ফলাফল পাওয়া গেছে। কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই যে দুধ বা ডেইরি প্রোডাক্ট স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, বরং কিছু গবেষণায় এর প্রতিরোধী ভূমিকার কথাও বলা হয়েছে। তাই এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। অন্যদিকে, কিছু গবেষণায় অতিরিক্ত মিষ্টিযুক্ত ডেইরি প্রোডাক্ট এবং “ফ্রোমেজ ব্ল্যাঙ্ক” (এক ধরণের নরম পনির) এর সাথে কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ার একটি সম্পর্ক দেখা গেছে, যদিও এটি নিয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন।
ফ্যাট বার্নিং এবং ওজন কমানোর দাবি
কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, ডেইরি প্রোডাক্ট শরীরের ফ্যাট কমাতে বা ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। এই দাবির পেছনে প্রধান যুক্তি হলো ক্যালসিয়াম। মনে করা হয়, ক্যালসিয়াম ফ্যাট কোষের মধ্যেকার বিপাক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং ফ্যাট জমার প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা লো-ক্যালোরি ডায়েটের সঙ্গে দিনে তিনবার দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করেছেন, তারা অন্যদের তুলনায় বেশি ওজন কমাতে সক্ষম হয়েছেন।
তবে, এই বিষয়ে সব গবেষণা একমত নয়। ওজন কমানোর জন্য সাধারণত লো-ফ্যাট দুধ বা দই খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ এতে ক্যালোরি কম থাকে। সুতরাং, শুধু ডেইরি প্রোডাক্ট খেলেই ওজন কমবে, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত শরীরচর্চার পাশাপাশি পরিমিত পরিমাণে দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করলে তা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।
শেষ কথা
ডেইরি প্রোডাক্ট এবং ক্যান্সারের সম্পর্কটি সরল নয়, বরং বেশ জটিল এবং বহুমুখী। এটি নির্ভর করে কোন ধরণের ডেইরি প্রোডাক্ট খাওয়া হচ্ছে (যেমন প্রোবায়োটিকযুক্ত দই বনাম উচ্চ ফ্যাটযুক্ত দুধ), কী পরিমাণে খাওয়া হচ্ছে এবং ব্যক্তির সামগ্রিক জীবনযাত্রার ওপর।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, গাঁজানো দুগ্ধজাত খাবার, বিশেষ করে টক দই, এর প্রোবায়োটিক উপাদানের জন্য স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী এবং এটি অন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে। অন্যদিকে, অতিরিক্ত পরিমাণে দুগ্ধজাত খাবার, বিশেষ করে উচ্চ ফ্যাটযুক্ত দুধ, প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
সুতরাং, কোনো খাবারকেই এককভাবে ‘ক্যান্সার প্রতিরোধী’ বা ‘ক্যান্সারের কারণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়। একটি সুষম এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্যাভ্যাসই ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং সামগ্রিক সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাদ্যতালিকা থেকে ডেইরি প্রোডাক্ট সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া বা অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করা, কোনোটিই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পরিমিত পরিমাণে, বিশেষ করে লো-ফ্যাট এবং প্রোবায়োটিক-সমৃদ্ধ বিকল্প বেছে নেওয়াই শ্রেয়।