রূপচর্চা ও প্রসাধনী আধুনিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী ব্যবহার করেন। তবে এই সৌন্দর্যের পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি, এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত। গবেষণা বলছে, বিভিন্ন প্রসাধনীতে ব্যবহৃত কিছু রাসায়নিক উপাদান মানবদেহের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
যে রাসায়নিকগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ
গবেষণায় মূলত দুটি রাসায়নিক উপাদানকে ক্যান্সারের ঝুঁকির সঙ্গে বিশেষভাবে শনাক্ত করা হয়েছে—প্যারাবেন এবং থ্যালেট। এই উপাদানগুলো বিভিন্ন প্রসাধনীতে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।
- প্যারাবেন (Parabens): মেকআপ, ময়েশ্চারাইজার, শ্যাম্পু, সাবান, এবং ডিওডোরেন্টের মতো পণ্যে প্যারাবেন প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের বৃদ্ধি রোধ করে পণ্যের মেয়াদ বাড়াতে সাহায্য করে। মিথাইল প্যারাবেন, প্রপাইল প্যারাবেন এবং বিউটাইল প্যারাবেনের মতো বিভিন্ন ধরনের প্যারাবেন প্রসাধনীতে পাওয়া যায়। এই রাসায়নিকগুলো শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মতো কাজ করতে পারে। যেহেতু ইস্ট্রোজেন হরমোন-রিসেপ্টর-পজিটিভ স্তন ক্যান্সারের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে, তাই প্যারাবেনের ব্যবহার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। গবেষণায় স্তন ক্যান্সারের টিস্যুতে প্যারাবেনের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে, যা এই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
- থ্যালেট (Phthalates): থ্যালেট মূলত নেলপলিশ, হেয়ার স্প্রে, লোশন এবং সুগন্ধীকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ব্যবহৃত হয়। এই রাসায়নিকটি প্লাস্টিককে নরম করার কাজেও লাগে। থ্যালেট সরাসরি ইস্ট্রোজেনের মতো কাজ না করলেও, এটি শরীরের হরমোন সিস্টেমে বাধা সৃষ্টি করে, যা এন্ডোক্রিন সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে প্রজনন ব্যবস্থায় সমস্যা এবং হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে, যা পরোক্ষভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
কীভাবে এই রাসায়নিকগুলো শরীরে প্রভাব ফেলে?
প্যারাবেন এবং থ্যালেটকে “হরমোন বিঘ্নকারী” (Endocrine Disruptors) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর কারণ হলো, এই রাসায়নিকগুলো মানবদেহের অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্রের (Endocrine System) স্বাভাবিক কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করে। হরমোন আমাদের শরীরের বৃদ্ধি, বিকাশ, ঘুম, মেজাজ এবং প্রজননের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রসাধনীতে থাকা রাসায়নিক পদার্থ নারীদের যৌন হরমোনকে প্রভাবিত করতে পারে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী নারীদের প্রস্রাবে প্যারাবেন, বেঞ্জোফেননের মতো রাসায়নিক পাওয়া গেছে, যা ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত প্রধান হরমোন ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ইস্ট্রোজেনের মাত্রার এই পরিবর্তন স্তন ক্যান্সারের মতো ইস্ট্রোজেন-নির্ভর রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
ঝুঁকি কমাতে করণীয়
প্রসাধনী ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
১. উপাদান তালিকা পড়ুন: যেকোনো প্রসাধনী কেনার আগে তার লেবেলে থাকা উপাদানগুলো ভালোভাবে পড়ে নিন। প্যারাবেন-মুক্ত (Paraben-free) এবং থ্যালেট-মুক্ত (Phthalate-free) পণ্য বেছে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
২. প্রাকৃতিক ও জৈব পণ্য ব্যবহার: রাসায়নিকযুক্ত পণ্যের পরিবর্তে প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি পণ্য ব্যবহার করা নিরাপদ। অ্যালোভেরা, চন্দন, গোলাপের পাপড়ি, নারিকেল তেল বা মধুর মতো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি প্রসাধনী ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. কম ব্যবহার: প্রসাধনীর ব্যবহার যথাসম্ভব সীমিত রাখুন। অতিরিক্ত মেকআপ বা রাসায়নিক পণ্যের ব্যবহার ত্বকের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করে এবং রাসায়নিক শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
৪. সচেতনতা বৃদ্ধি: প্রসাধনীর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে নিজে সচেতন হন এবং অন্যকেও সচেতন করুন। কোন পণ্যগুলো আপনার ত্বকের জন্য উপযুক্ত, তা জানতে একজন ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ক্ষতিকর রাসায়নিকযুক্ত পণ্য ব্যবহার বন্ধ করে দিলে তার ইতিবাচক প্রভাব শরীরে দ্রুত দেখা যায়। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, মাত্র ২৮ দিনের জন্য প্যারাবেন ও থ্যালেটমুক্ত পণ্য ব্যবহার করলে স্তন ক্যান্সারের জন্য দায়ী কিছু জিনের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, সৌন্দর্যচর্চা জীবনের অংশ হতে পারে, কিন্তু তা যেন স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। সঠিক তথ্য ও সচেতনতার মাধ্যমে আমরা নিরাপদ পণ্য বেছে নিতে পারি এবং এক স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর জীবনযাপন করতে পারি।