ক্যান্সার চিকিৎসার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য বিশ্বের প্রথম mRNA ভ্যাকসিনের হিউম্যান ট্রায়াল শুরু হয়েছে। বায়োএনটেক (BioNTech) কোম্পানির তৈরি এই ভ্যাকসিনের নাম BNT116। কোভিড-১৯ এর টিকা আবিষ্কার করে খ্যাতি পাওয়া এই জার্মান সংস্থাটি এবার ফুসফুসের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে। এই টিকাটি নন-স্মল সেল ফুসফুসের ক্যান্সার (NSCLC)-কে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে, যা ফুসফুসের ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ এবং মারাত্মক রূপ।
এই টিকার মূল উদ্দেশ্য হলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ক্যান্সারের কোষ শনাক্ত করতে এবং ধ্বংস করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া। এর ফলে শুধু বর্তমান টিউমারই নয়, বরং ভবিষ্যতে ক্যান্সারের পুনরাবৃত্তিও রোধ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হাজার হাজার রোগীর জন্য নতুন আশার সঞ্চার করেছে, যাদের অনেকেই এই রোগের উন্নত পর্যায়ে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হন।
ক্লিনিকাল ট্রায়ালের পরিধি এবং পদ্ধতি
BNT116 ভ্যাকসিনের প্রথম ধাপের ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে বিশ্বের সাতটি দেশের ৩৪টি গবেষণা কেন্দ্রে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্পেন এবং তুরস্ক। যুক্তরাজ্যে প্রথম এই টিকাটি পেয়েছেন ৬৭ বছর বয়সী জানুস রাক্স নামের একজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ। মে মাসে তার রোগ নির্ণয়ের পর কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপি শুরু হয়। লন্ডনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ রিসার্চ (NIHR) ইউসিএলএইচ ক্লিনিকাল রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে তাকে এই টিকা দেওয়া হয়।
ট্রায়ালে অংশ নেওয়া রোগীদের মধ্যে প্রায় ১৩০ জনকে সার্জারি বা রেডিওথেরাপির আগে ইমিউনোথেরাপির পাশাপাশি এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এই গবেষণার লক্ষ্য হলো, কেমোথেরাপির পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর কোষগুলোকে অক্ষত রেখে শুধুমাত্র ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে রোগীর নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তোলা। গবেষকরা আশা করছেন, এই ভ্যাকসিন ক্যান্সারের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারবে এবং ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের আয়ু বাড়াতে সাহায্য করবে।
mRNA প্রযুক্তি এবং কার্যকারিতা
কোভিড-১৯ টিকার মতোই BNT116 ভ্যাকসিনটিও মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। এই প্রযুক্তিতে, কৃত্রিমভাবে তৈরি mRNA কোষের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়, যা কোষকে নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরি করার নির্দেশ দেয়। ফুসফুসের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে, এই mRNA শরীরের প্রতিরোধ কোষগুলোকে ক্যান্সারের কোষের পৃষ্ঠে থাকা নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন শনাক্ত করতে শেখায়। এর ফলে, প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং শুধুমাত্র ক্যান্সার কোষগুলোকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে, কিন্তু সুস্থ কোষগুলোর কোনো ক্ষতি করে না।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন হসপিটালস (UCLH) এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের কনসালটেন্ট মেডিকেল অনকোলজিস্ট অধ্যাপক সিও মিং লি এই পরীক্ষাকে ক্যান্সার চিকিৎসার পরবর্তী বড় পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “৪০ বছর ধরে আমি ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করছি। আমরা আশা করি এই ভ্যাকসিন ক্যান্সার ফিরে আসার পথ বন্ধ করবে।”
নন-স্মল সেল ফুসফুসের ক্যান্সার (NSCLC)
নন-স্মল সেল ফুসফুসের ক্যান্সার (NSCLC) হলো ফুসফুসের ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ প্রকার, যা প্রায় ৮৫% ক্ষেত্রে দেখা যায়। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ধূমপান অন্যতম। এছাড়াও পরিবেশগত দূষণ, যেমন – রেডন গ্যাস, অ্যাসবেস্টস এবং অন্যান্য রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসাও এই ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট এবং অপ্রত্যাশিতভাবে ওজন কমে যাওয়া।
সাধারণত, NSCLC-এর চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের পর্যায়ের ওপর। প্রাথমিক পর্যায়ে সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি এবং কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। উন্নত পর্যায়ে টার্গেটেড থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি ব্যবহার করা হয়। BNT116 ভ্যাকসিনের সাফল্য এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে, যা আরো কার্যকর এবং কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
যদিও BNT116 ভ্যাকসিন এখনও তার প্রাথমিক পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে, এর পেছনের প্রযুক্তি এবং প্রাথমিক ধারণা ক্যান্সার গবেষণায় একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। যদি এই ট্রায়াল সফল হয়, তবে এটি ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসায় বিপ্লব আনবে। বায়োএনটেক এবং বিশ্বের অন্যান্য গবেষকরা এখন শুধু ফুসফুসের ক্যান্সারই নয়, বরং অন্যান্য ধরনের ক্যান্সারের জন্যও mRNA ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছেন। এই গবেষণাগুলো সফল হলে ক্যান্সারের মতো মারণব্যাধির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই এক নতুন দিশা পাবে।