আমরা প্রতিদিন যে প্লাস্টিক ব্যবহার করি, তা আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু এই প্লাস্টিকই যখন ভেঙে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কণায় পরিণত হয়, তখন তা আমাদের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এই অদৃশ্য প্লাস্টিক কণাকেই বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক, যা এখন ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
মাইক্রোপ্লাস্টিক কী? কীভাবে এটি আমাদের শরীরে ঢোকে?
যখন প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ বা যেকোনো জিনিস পরিবেশে ফেলে দেওয়া হয়, তখন তা রোদ, বৃষ্টি এবং বাতাসের কারণে ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করে। এভাবে ভাঙতে ভাঙতে যখন প্লাস্টিকের কণাগুলো আমাদের খালি চোখে প্রায় দেখাই যায় না, তখন তাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলে।
এই ক্ষুদ্র কণাগুলো এতটাই ছোট যে, তা খুব সহজেই আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। বাতাসের মাধ্যমে শ্বাসের সাথে, পানির মাধ্যমে এবং খাবারের সাথে এটি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। সামুদ্রিক মাছ, লবণ, বোতলজাত পানি, এমনকি চা-পাতার মতো সাধারণ খাবার থেকেও আমরা অজান্তেই প্রতিদিন হাজার হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা খাচ্ছি। বিজ্ঞানীরা মানুষের রক্ত, ফুসফুস এবং এমনকি মায়ের বুকের দুধেও এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। এর মানে হলো, এই নীরব শত্রু আমাদের শরীরের গভীরে পৌঁছে গেছে।
বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় মাস্ক, গ্লাভস এবং স্যানিটাইজারের বোতলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে।
শরীরের ভেতরে মাইক্রোপ্লাস্টিক কীভাবে ক্ষতি করে?
মাইক্রোপ্লাস্টিকের আসল বিপদ হলো এর ক্ষুদ্র আকার এবং রাসায়নিক ধর্ম। শরীরে প্রবেশের পর এটি নানাভাবে আমাদের কোষগুলোকে অসুস্থ করে তুলতে পারে।
১. বিষাক্ত পদার্থের বাহক: মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা অনেকটা স্পঞ্জের মতো কাজ করে। এটি পরিবেশে থাকা অন্যান্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক, যেমন—কারখানার বর্জ্য, কীটনাশক এবং ভারী ধাতু নিজের গায়ে জড়িয়ে নেয়। যখন আমরা খাবারের মাধ্যমে এই কণাগুলো গ্রহণ করি, তখন ওই বিষাক্ত পদার্থগুলোও সরাসরি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।
২. শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি: আমাদের শরীর যখন কোনো অচেনা বস্তুকে শনাক্ত করে, তখন তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। একে সহজ ভাষায় শরীরের ভেতরের জ্বালাপোড়া বা প্রদাহ বলা যেতে পারে। মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো কোষে প্রবেশ করে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ তৈরি করে, যা আমাদের কোষগুলোকে দুর্বল করে দেয়।
৩. কোষের ক্ষতি: এই দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের সাথে বয়ে আনা বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে আমাদের কোষের মূল চালিকাশক্তি, অর্থাৎ ডিএনএ (DNA) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ডিএনএ হলো প্রতিটি কোষের জন্য একটি নির্দেশিকা বইয়ের মতো। যখন এই নির্দেশিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখনই শরীরে নানা রকম রোগ বাসা বাঁধে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ক্যান্সারের সম্পর্ক ঠিক কোথায়?
ক্যান্সার এমন একটি রোগ যেখানে শরীরের কোষগুলো তাদের স্বাভাবিক নিয়ম ভুলে গিয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে। এর মূল কারণ হলো কোষের ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। মাইক্রোপ্লাস্টিক ঠিক এই কাজটিই করে।
- ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়: প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত কিছু রাসায়নিক, যেমন—বিসফেনল-এ (BPA), আমাদের শরীরের হরমোনের কাজে বাধা দেয়। এটি বিশেষ করে মহিলাদের স্তন ক্যান্সার এবং পুরুষদের প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- কোষের বিভাজন অনিয়ন্ত্রিত করে: গবেষণায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক কোষের স্বাভাবিক বিভাজন প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে দেয়। ফলে কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে শুরু করে, যা একসময় টিউমারে পরিণত হয়। শিল্প কারখানার শ্রমিকদের ওপর চালানো সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘ সময় ধরে প্লাস্টিকের সংস্পর্শে কাজ করেন, তাদের মধ্যে ফুসফুসের রোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি।
আমাদের কী করার আছে?
মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিপদ থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা হয়তো কঠিন, কিন্তু কিছু সাধারণ অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা এর থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারি।
- একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জন: প্লাস্টিকের স্ট্র, কাপ, প্লেট এবং পানির বোতল যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।
- সঠিক খাদ্যাভ্যাস: প্যাকেটজাত খাবারের বদলে তাজা ও প্রাকৃতিক খাবার বেশি করে খান।
- নিরাপদ পানি পান: প্লাস্টিকের বোতলের পরিবর্তে ফিল্টার করা বা ফোটানো বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
- প্রাকৃতিক পোশাক: সিনথেটিক বা পলিয়েস্টার কাপড়ের বদলে সুতির পোশাক পরুন। কারণ সিনথেটিক কাপড় ধোয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিকের আঁশ পানিতে মেশে।
শেষ কথা হলো, মাইক্রোপ্লাস্টিক এক নীরব ঘাতক, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। দৈনন্দিন জীবনে ছোট ছোট কিছু ভালো অভ্যাস গড়ে তুলে আমরা প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে পারি এবং নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ জীবন উপহার দিতে পারি।