ক্যান্সার চিকিৎসায় রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতিগুলো বরাবরই কিছুটা কষ্টদায়ক এবং সময়সাপেক্ষ। বিশেষ করে, বায়োপসি শব্দটি শুনলেই রোগীর মনে একটা ভয়ের সঞ্চার হয়। শরীরের কোনো সন্দেহজনক অংশ থেকে টিস্যু বা কোষ কেটে নিয়ে তা পরীক্ষা করার এই প্রচলিত পদ্ধতিটি যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই এর কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে এই ধারণার আমূল পরিবর্তন হতে চলেছে। আর এই পরিবর্তনের অন্যতম পথিকৃৎ হলো “লিকুইড বায়োপসি” (Liquid Biopsy)।
এটি মূলত একটি রক্ত পরীক্ষা, যার মাধ্যমে রক্তে ভাসমান টিউমারের ক্ষুদ্র অংশ বা ডিএনএ শনাক্ত করে ক্যান্সার নির্ণয় করা সম্ভব। এই যুগান্তকারী প্রযুক্তি শুধু ক্যান্সার নির্ণয়কেই সহজ করছে না, বরং চিকিৎসার গতিপথ নির্ধারণ এবং রোগ পর্যবেক্ষণেও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
লিকুইড বায়োপসি আসলে কী?
লিকুইড বায়োপসি হলো একটি নন-ইনভেসিভ বা ন্যূনতম কাটাছেঁড়ার বিকল্প, যেখানে মূলত রক্ত, মূত্র বা লালার মতো শারীরিক তরল বিশ্লেষণ করা হয়। যখন শরীরে কোনো টিউমার বৃদ্ধি পায়, তখন তার কিছু কোষ ভেঙে গিয়ে বা মৃত কোষ থেকে ডিএনএ-এর ক্ষুদ্র খণ্ড (Fragment) রক্তস্রোতে মিশে যায়। এই কোষগুলোকে বলা হয় সার্কুলেটিং টিউমার সেলস (CTCs) এবং ডিএনএ-এর খণ্ডগুলোকে বলা হয় সার্কুলেটিং টিউমার ডিএনএ (ctDNA)।] লিকুইড বায়োপসি পরীক্ষায় মূলত এই CTCs এবং ctDNA-কেই শনাক্ত করা হয়। এই ডিএনএ খণ্ডগুলোতে টিউমারের জেনেটিক মিউটেশন বা পরিবর্তনের তথ্য থাকে, যা ক্যান্সারের ধরন ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা দেয়।
লিকুইড বায়োপসি বনাম টিস্যু বায়োপসি
ক্যান্সার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে টিস্যু বায়োপসিকে এখনও “গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড” বা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ, এটি টিউমারের কোষীয় গঠন সম্পর্কে সরাসরি এবং বিস্তারিত তথ্য দেয়। কিন্তু এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে:
- আক্রমণাত্মক পদ্ধতি: টিস্যু বায়োপসিতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়, যা রোগীর জন্য কষ্টদায়ক এবং ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
- অবস্থানগত সমস্যা: শরীরের কিছু অঙ্গ, যেমন— ফুসফুস বা মস্তিষ্কের টিউমারের ক্ষেত্রে বায়োপসি করা বেশ কঠিন ও বিপজ্জনক।
- টিউমারের ভিন্নতা (Heterogeneity): একটি টিউমারের বিভিন্ন অংশে জেনেটিক গঠন ভিন্ন হতে পারে। টিস্যু বায়োপসিতে একটি নির্দিষ্ট অংশ থেকে নমুনা নেওয়ায় টিউমারের সম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া সম্ভব হয় না।
এর বিপরীতে, লিকুইড বায়োপসির অনেক সুবিধা রয়েছে:
- সহজ ও নিরাপদ: এটি একটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মতোই, যা প্রায় ঝুঁকিমুক্ত এবং কম বেদনাদায়ক।
- সম্পূর্ণ চিত্র: রক্তস্রোতে যেহেতু টিউমারের বিভিন্ন অংশের ডিএনএ এসে মেশে, তাই লিকুইড বায়োপসি টিউমারের জেনেটিক ভিন্নতা সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা দিতে পারে। [১৪, ১৫]
- পুনরাবৃত্তির সুবিধা: এই পরীক্ষা বারবার করা সম্ভব, যা চিকিৎসার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ এবং রোগ ফিরে আসার ঝুঁকি নিরীক্ষণে অত্যন্ত সহায়ক। [৪, ৯]
- দ্রুত ফলাফল: টিস্যু বায়োপসির তুলনায় এর ফলাফল অনেক দ্রুত পাওয়া যায়। [১০, ২৪]
লিকুইড বায়োপসির প্রয়োগ ও কার্যকারিতা
লিকুইড বায়োপসির ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপক এবং সম্ভাবনাময়:
১. প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয়: অনেক ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গহীন থাকে। লিকুইড বায়োপসি রক্তে ctDNA-এর উপস্থিতি শনাক্ত করে লক্ষণ প্রকাশের আগেই ক্যান্সার নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে, যা চিকিৎসার সাফল্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। ফুসফুস, স্তন, কোলোরেক্টাল এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারের মতো বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে।
২. চিকিৎসার পরিকল্পনা: ctDNA বিশ্লেষণ করে টিউমারের জেনেটিক মিউটেশন, যেমন— EGFR জিনের পরিবর্তন শনাক্ত করা যায়। এর মাধ্যমে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন কোন নির্দিষ্ট টার্গেটেড থেরাপি রোগীর জন্য সবচেয়ে কার্যকর হবে।
৩. চিকিৎসার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ: চিকিৎসার ফলে টিউমার সাড়া দিচ্ছে কিনা, তা বোঝার জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর লিকুইড বায়োপসি করা হয়। রক্তে ctDNA-এর পরিমাণ কমে যাওয়া চিকিৎসার সাফল্যের ইঙ্গিত দেয়।
৪. রোগের পুনরাবৃত্তি শনাক্তকরণ: চিকিৎসার পর ক্যান্সার আবার ফিরে আসছে কিনা, তা নিরীক্ষণের জন্য লিকুইড বায়োপসি অত্যন্ত কার্যকর। [৫, ৩১] শারীরিক লক্ষণ বা ইমেজিং টেস্টে ধরা পড়ার অনেক আগেই এই পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ পুনরাবৃত্তির সংকেত পাওয়া যায়।
৫. ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বোঝা: অনেক সময় ক্যান্সারের কোষগুলো নির্দিষ্ট ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। লিকুইড বায়োপসির মাধ্যমে এই জেনেটিক পরিবর্তনগুলো শনাক্ত করে সেই অনুযায়ী চিকিৎসার কৌশল বদলানো সম্ভব। [৯]
সীমাবদ্ধতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
লিকুইড বায়োপসি একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন:
- প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সারে রক্তে ctDNA-এর পরিমাণ খুব কম থাকায় তা শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে, যা “ফলস নেগেটিভ” ফলাফলের ঝুঁকি বাড়ায়।
- বার্ধক্যজনিত কারণে রক্তকোষে কিছু জেনেটিক পরিবর্তন (CHIP) ঘটতে পারে, যা ক্যান্সারের ctDNA হিসেবে ভুলভাবে শনাক্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে।
- বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পদ্ধতি ও মানের ভিন্নতার কারণে ফলাফলের তারতম্য হতে পারে।
তবে এই সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য গবেষণা চলছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিং-এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষার নির্ভুলতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এখন এমন পরীক্ষা তৈরির চেষ্টা করছেন যা একটি মাত্র রক্ত নমুনা থেকে ৫০টিরও বেশি ধরনের ক্যান্সার শনাক্ত করতে সক্ষম।
উপসংহার
লিকুইড বায়োপসি নিঃসন্দেহে ক্যান্সার চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। যদিও এটি এখনও সব ক্ষেত্রে টিস্যু বায়োপসির বিকল্প হয়ে ওঠেনি, তবে পরিপূরক হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কম কষ্টদায়ক, নিরাপদ এবং বারবার করার সুবিধা থাকায় এটি রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করার পাশাপাশি চিকিৎসকদেরকেও রোগ সম্পর্কে রিয়েল-টাইম তথ্য দিয়ে চলেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে অদূর ভবিষ্যতে লিকুইড বায়োপসি ক্যান্সার নির্ণয় ও পর্যবেক্ষণের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠবে, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে।