স্তন ক্যান্সার নারীদের জন্য এক মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে লক্ষ লক্ষ নারী এই মরণব্যাধির শিকার হচ্ছেন। বর্তমানে এই ক্যান্সার শনাক্তের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে ম্যামোগ্রাফি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এটি দেরিতে রোগ শনাক্ত করে, যার ফলে জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয় না। ঠিক এই জায়গাতেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগান্তকারী এক আবিষ্কার এনে দিয়েছে নতুন আশার আলো—একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি যার নাম Mirai (Machine learning-based risk assessment of breast cancer in AI)।
ক্যান্সার শনাক্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার: পরিবর্তনের সূচনা
MIT-এর প্রফেসর রেজিনা বারজিলেই ও তাঁর ছাত্র আদম ইয়ালা দীর্ঘদিন গবেষণা করে এমন এক প্রযুক্তি তৈরি করেছেন, যা ম্যামোগ্রাম থেকে আগাম ঝুঁকি নির্ণয়ের সক্ষমতা রাখে। এই প্রযুক্তি শুধু ম্যামোগ্রাফির উপর নির্ভর না করে, তার গভীর স্তরে লুকানো সম্ভাব্য ঝুঁকির চিহ্ন খুঁজে বের করতে পারে।
Mirai নামের এই AI সিস্টেমটি প্রশিক্ষিত হয়েছে হাজার হাজার ম্যামোগ্রাম চিত্রের ওপর, যেগুলোর ফলাফল আগে থেকেই জানা ছিল। এই ছবিগুলোর পিক্সেল বিন্যাস বিশ্লেষণ করে এটি ভবিষ্যদ্বাণী করতে শেখে—কে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনায় আছে।
এটি অনেকটা আমাদের মোবাইল ফোনে ফেস রিকগনিশন সফটওয়্যারের মতোই কাজ করে—হাজারো উদাহরণ দিয়ে মেশিনকে শেখানো হয়, এবং সেটি ধীরে ধীরে নিখুঁতভাবে চেহারা চিনে নিতে পারে। তেমনি Mirai ম্যামোগ্রামের ছবির অগোচর নিদর্শন দেখে আগাম বিপদের সংকেত চিহ্নিত করতে পারে।
সময়ের আগে ঝুঁকি শনাক্ত: জীবন বাঁচানোর নতুন পথ
এই প্রযুক্তির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এটি ঐসব নারীদেরও উচ্চ-ঝুঁকির তালিকায় ফেলতে সক্ষম, যাদের বর্তমান ম্যামোগ্রাফি পদ্ধতিতে কোনো সমস্যা ধরা পড়ে না। রেজিনা নিজেই তাঁর ২০১২ সালের ম্যামোগ্রাম Mirai দিয়ে বিশ্লেষণ করিয়েছিলেন। তখন AI বলেছিল তিনি উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন—যা দুই বছর পর ২০১৪ সালে চিকিৎসকেরা আবিষ্কার করেন। এই ঘটনা Mirai-এর কার্যকারিতার একটি বাস্তব উদাহরণ।
এই প্রযুক্তি বর্তমানে পরীক্ষাধীন পর্যায়ে থাকলেও, প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী এর সঠিকতার হার প্রায় ৭৬%, যা লক্ষ লক্ষ নারীর জন্য এক বিরাট সম্ভাবনা।
রোগ নির্ণয়ের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধেও ভূমিকা
শুধু স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করাই নয়, Mirai দিয়ে আগাম সতর্কতা পাওয়ার ফলে রোগী তাঁর জীবনধারা বদলাতে পারেন। ওষুধ গ্রহণ, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, কিংবা নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রোগের সম্ভাব্যতা অনেকাংশে কমানো যেতে পারে। এতে শুধু রোগ নির্ণয়ের সময় নয়, চিকিৎসার কৌশলও আগেভাগেই নির্ধারণ করা যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসার সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যত আগে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হয়, চিকিৎসাও তত সহজ হয় এবং সুস্থতা পাওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যায়। Mirai সেই আগাম সতর্কতার সুযোগ এনে দিয়েছে।
প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ ও মানবিক প্রভাব
Mirai এখনো চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষায় আছে, এবং চিকিৎসকরা এটিকে বর্তমানে প্রচলিত ম্যামোগ্রাফি কিংবা অন্যান্য পরীক্ষার বিকল্প হিসেবে নয়, বরং পরিপূরক হিসেবে দেখছেন। তবে ভবিষ্যতে যদি এটি সবার জন্য সহজলভ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে, তাহলে একে চিকিৎসাক্ষেত্রে একটি Game Changer হিসেবে ধরা হবে।
AI-এর এই রকম মানবিক প্রয়োগ শুধু রোগ নির্ণয়ের প্রযুক্তিকেই নয়, মানবিকতাকেও এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। যারা আগে কখনো সময়মতো সচেতন হতে পারেননি, তাদের জন্য Mirai হতে পারে ভবিষ্যতের এক জীবনদায়ী আলোকবর্তিকা।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে সম্ভাবনা
বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে চিকিৎসা অবকাঠামো এখনো সীমিত, সেখানে AI নির্ভর প্রযুক্তি, যদি সহজলভ্য ও খরচ-সাশ্রয়ী হয়, তবে স্বাস্থ্যখাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। এখানে অনেক নারী নিয়মিত ম্যামোগ্রাম করাতে পারেন না, বা সমস্যার উপসর্গ বুঝলেও দেরিতে চিকিৎসকের কাছে যান। সেখানে Mirai যদি মোবাইল হেলথ ইউনিটের মাধ্যমে বা সরকারি প্রকল্পের আওতায় ব্যবহার করা যায়, তাহলে দ্রুত বহু জীবন রক্ষা করা সম্ভব।
শেষকথা
Mirai প্রযুক্তি আজ কেবল একটি উদ্ভাবন নয়—এটি একটি সম্ভাবনার নাম, একটি সাহসী পদক্ষেপ সময়ের আগে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করার জন্য। এটি শুধু একটি মেশিন লার্নিং মডেল নয়; বরং কোটি নারীর জীবনের সঙ্গে জড়িত এক মানবিক প্রযুক্তি। আধুনিক প্রযুক্তির জগতে এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিজ্ঞান ও মানবতা যখন একসাথে কাজ করে, তখনই সত্যিকারের ‘উন্নয়ন’ সম্ভব।
একদিন, হয়তো খুব শিগগিরই, Mirai হয়ে উঠবে প্রতিটি নারীর স্বাস্থ্যপরীক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ—যেখানে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হবে আগেই, আর জীবন থাকবে সুরক্ষিত। এই নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় আমরা সবাই।