বিজ্ঞান প্রতিনিয়তই আমাদের চমকে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ‘মারণব্যাধি’ হিসেবে পরিচিত ক্যান্সার চিকিৎসার পথে আজ এক যুগান্তকারী সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। হার্পিস ভাইরাস—একটি ভীতিকর নাম যা সাধারণত ঠোঁটে ফোস্কার জন্য দায়ী—এবার চিকিৎসাবিজ্ঞানের হাত ধরে হয়ে উঠেছে আমাদের এক সম্ভাব্য ত্রাতা।
২০২৫ সালের আমেরিকান সোসাইটি অফ ক্লিনিক্যাল অনকোলজি (ASCO) বার্ষিক সম্মেলনে এমনই এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, যা চিকিৎসা জগতে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। সেখানে এক নতুন ধরনের ভাইরাসভিত্তিক থেরাপি—RP1—উপস্থাপন করা হয় যা মেলানোমা নামক মারাত্মক ত্বক ক্যান্সারের বিরুদ্ধে অসাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
মেলানোমা: এক নীরব ঘাতক
মেলানোমা হচ্ছে ত্বকের ক্যান্সারের সবচেয়ে ভয়ংকর ধরন। সাধারণত ত্বকের রঙের জন্য দায়ী মেলানোসাইট নামক কোষ থেকেই এর উৎপত্তি। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে এটি সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হলেও, একবার ছড়িয়ে পড়লে এটি জীবনঘাতী হয়ে ওঠে। প্রচলিত চিকিৎসা—যেমন অস্ত্রোপচার, রেডিওথেরাপি বা ইমিউনোথেরাপি—প্রতিটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই নতুন সমাধানের খোঁজ বিজ্ঞানীদের অবিরত প্রচেষ্টা।
RP1: ভাইরাস দিয়ে ক্যান্সার চিকিৎসার নতুন অধ্যায়
RP1 হলো একটি জিনগতভাবে পরিবর্তিত হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস (HSV-1)। এই ভাইরাসকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে যাতে এটি ক্যান্সার কোষগুলোতে ঢুকে তাদের ধ্বংস করে এবং শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে আরও বেশি ক্যান্সার কোষকে আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
বিশেষভাবে, RP1 একাই নয়; এটি nivolumab নামক একটি শক্তিশালী ইমিউনোথেরাপি ওষুধের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। একত্রে তারা শরীরে এমন একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করে, যা শুধু এক জায়গার টিউমার নয়—সমগ্র শরীরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে সক্ষম।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের রোমাঞ্চকর ফলাফল
গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন এমন ১৪০ জন রোগী, যাদের ক্যান্সার আগের কোনো চিকিৎসার প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দিচ্ছিল না। এই গবেষণায় দেখা গেছে:
- ৩০% রোগীর টিউমার ছোট হয়ে এসেছে, অর্থাৎ RP1 ও Nivolumab এর যুগলবন্দি কার্যকর হয়েছে।
- সবচেয়ে আশ্চর্যজনক তথ্য: এই ৩০% রোগীর মধ্যে অর্ধেকের শরীর থেকে সব টিউমার পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে।
এই ফলাফল শুধুমাত্র সংখ্যা নয়, এটি কোটি কোটি ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর জীবনে আশার আলো হয়ে উঠতে পারে।
T-VEC বনাম RP1: কী পার্থক্য?
RP1 আগেও ব্যবহৃত ভাইরাস-ভিত্তিক থেরাপি T-VEC এর চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর:
- T-VEC কেবল ত্বকের উপরিভাগে থাকা টিউমার-এ ব্যবহারযোগ্য।
- RP1 ব্যবহার করা যায় গভীর টিউমারে, এমনকি অভ্যন্তরীণ অঙ্গেও।
- RP1 ক্যান্সার কোষগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে ফিউজ করে, যাতে শরীরের ইমিউন প্রতিক্রিয়া আরও জোরালো হয়।
এভাবে RP1 কেবল ভাইরাস নয়, এক ‘বায়োলজিক্যাল ওয়েপন’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ক্যান্সার যুদ্ধে।
ভাইরাল থেরাপির ইতিহাস: ভয় থেকে ভরসায়
ভাইরাসকে ব্যবহার করে ক্যান্সার চিকিৎসা নতুন নয়, ধারণাটি শত বছর আগেই জন্ম নিয়েছিল। তবে নিরাপত্তা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি থাকায় এটি দীর্ঘদিন গবেষণার স্তরে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আধুনিক জিন প্রকৌশল এবং বায়োটেকনোলজির উন্নতিতে আজ এই ধারণাটি বাস্তব রূপ নিচ্ছে।
RP1-এর সম্ভাব্য অনুমোদন হলে এটি হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ইউরোপে মাত্র দ্বিতীয় ভাইরাস-ভিত্তিক ক্যান্সার থেরাপি, যা সরকারি স্বীকৃতি পাবে।
FDA-এর সামনে RP1: আশার প্রতীক্ষা
এই মাসের (জুলাই ২০২৫) শেষের দিকেই মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) এর সিদ্ধান্ত আসতে পারে। যদি RP1 অনুমোদন পায়, তাহলে এটি হবে চিকিৎসাশাস্ত্রে এক যুগান্তকারী মাইলফলক।
এই থেরাপি কেবল মেলানোমা নয়, ভবিষ্যতে ব্রেস্ট ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার বা এমনকি ব্রেন টিউমার চিকিৎসায়ও ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ RP1-এর মূল শক্তি হলো: এটি ক্যান্সার কোষকে একদিকে ধ্বংস করে, অন্যদিকে শরীরের ইমিউন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিখুঁতভাবে সক্রিয় করে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও মানবিক প্রভাব
এই থেরাপির প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে সেইসব রোগী, যাদের আর কোনো বিকল্প চিকিৎসা নেই। RP1 তাদের জন্য হতে পারে শেষ আশার আলো। তাছাড়া এই চিকিৎসার মাধ্যমে চিকিৎসা খরচ, হসপিটালাইজেশন সময়, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি অনেকটাই কমে যেতে পারে।
এখনো যেহেতু RP1 পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে আছে, তাই বিস্তৃতভাবে এটি প্রয়োগে সময় লাগবে। তবে FDA অনুমোদন মানেই একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
উপসংহার
এক সময় যেই ভাইরাস ছিল আমাদের আতঙ্কের কারণ, আজ সেই ভাইরাসই হয়ে উঠছে বাঁচার হাতিয়ার। হার্পিস ভাইরাস-ভিত্তিক RP1 থেরাপি মেলানোমার মতো ভয়ঙ্কর ক্যান্সারের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামে এক বিশাল অগ্রগতি। এটি শুধু চিকিৎসাশাস্ত্র নয়, মানব সভ্যতার জয়গান।
আমরা হয়তো এমন এক ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়—বরং একটি লড়াই, যা জেতা সম্ভব।