বিকিরণ চিকিৎসার চমকপ্রদ বিবর্তন

বিকিরণ বা রেডিয়েশন থেরাপির ইতিহাস ও বিবর্তন নিশ্চিতভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।

প্রথম দিকে, ১৮৯৫ সালে উইলহেম কনরাড রন্টজেনএক্স-রে আবিষ্কার করলে চিকিৎসা ক্ষেত্রের পরিমণ্ডলে বিপ্লব ঘটে। চিত্রগ্রহণের এই নতুন পদ্ধতি শরীরের অভ্যন্তরীন কাঠামো পর্যবেক্ষণের সুযোগ এনে দেয়, তবে তখনকার সরঞ্জাম ছিল অতি ভারী এবং বিকিরণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতার অভাব ছিল। অনেকে বিকিরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত না থাকায় সুরক্ষামূলক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতেন না যার ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরী হয়েছিল।

১৯১০-এর দিকে মাদাম মেরি কুরী রেডিয়াম আবিষ্কার করে বিকিরণ থেরাপিতে নতুন মাত্রা যোগ করেন। রেডিয়াম-ক্যাপসুলগুলো দেহের টিউমারে প্রয়োগের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংসের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। রেডিয়াম থেরাপির  সেই যুগে ক্যাপসুল এবং ক্যাথেটারের মাধ‍্যমে সরাসরি রেডিয়াম প্রবেশ করানো হতো, যা তখনকার অবকাঠামোর জন্য অত্যন্ত দামী এবং রেডিয়েশন নিরাপত্তা নীতিমালার অভাবে বিপদজনক ছিল।

পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৫০-৬০-এর দশকে ‘কোব্যাল্ট–৬০’ (Cobalt-60) টেলিথেরাপি মেশিন আবির্ভাব ঘটে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের ক্যানসার চিকিৎসার জন্য কুমুদিনী হাসপাতালে সেই ১৯৪৮ সালে প্রথম রেডিওথেরাপি যন্ত্র বসানো হয়।

পরে সত্তরের দশকে ডিপ-এক্সরে মেশিন সরিয়ে দেশের কয়েকটি হাসপাতালে কোব্যাল্ট-৬০ ইউনিট স্থাপিত হয়। কোব্যাল্ট-৬০ থেকে উৎপন্ন গামা বিকিরণ তখনকার তুলনামূলকভাবে দ্রুতগতিতে টিউমারে ডোজ পৌঁছে দিত এবং আশেপাশের স্বাভাবিক টিস্যুতে ক্ষতি কমাত। কোব্যাল্ট-৬০ টেলিথেরাপি মেশিন পরিচালনার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট এবং মেডিক্যাল ফিজিসিস্টরা, যাদের মূল কাজ ছিল ডোজ ক্যালিব্রেশন, সেফটি প্রোটোকল অনুসরণ এবং সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা।

দ্বিতীয় দিকের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর (লিনাক) প্রযুক্তির বিকাশে। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে লিনাক বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই মেশিন উচ্চ-এনার্জির এক্স-রে বীম উৎপাদন করে, যা নির্ভুলভাবে টিউমারের আকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে দিত। বিশেষ করে ইন্টেন্সিটি-মানেজড রেডিয়েশন থেরাপি (IMRT) এবং ইমেজ-গাইডেড রেডিয়েশন থেরাপি (IGRT) প্রযুক্তি বিকিরণ চিকিৎসাকে অনেক আধুনিক করে তুলেছে। IMRT পদ্ধতিতে বিভিন্ন দিকে বিকিরণ বিমের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করে টিউমারকে ঘিরে দেয় এবং আশেপাশের কোষ নিরাপদ রাখে। আর IGRT পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিটি সেশনে রোগীর অবস্থান নির্ভুলভাবে সনাক্ত করে বিকিরণের সঠিক ডেলিভারি নিশ্চিত করা হয়।

অভ্যন্তরীণ বিকিরণ চিকিৎসা, অর্থাৎ ব্র্যাকিথেরাপি, ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। অতীতে অনকোলজিস্টর হাতে-কলমে পরিকল্পনা করতেন কিন্তু বর্তমানে সি-টিভি, এম-আর-আই এবং পিইটি স্ক্যানের সহায়তায় থ্রিডি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। বিশেষ করে গাইনেকোলজিক্যাল ক্যান্সারের ক্ষেত্রে উচ্চ-ডোজ রেট (HDR) ব্র্যাকিথেরাপি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে; এতে করে রেডিওনুক্লিয়াইড ক্যাথেটার মোল্ড করা ইন্সট্রুমেন্টসের মাধ্যমে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে টিউমারে উচ্চমাত্রার বিকিরণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

গত দশকে বিশ্বব্যাপী প্রোটন থেরাপি এবং কার্বন-আয়ন থেরাপি সেন্টার গড়ে ওঠার ধারা শুরু হয়েছে। প্রোটন থেরাপিতে বিকিরণ কণা টিউমারের নির্দিষ্ট গভীরে কনসেন্ট্রেট করা যায়, ফলে আশেপাশের স্বাভাবিক টিস্যু প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। যদিও বাংলাদেশে এখনও সরাসরি কোনো প্রোটন থেরাপি ইউনিট নেই, তবে ভারত ও থাইল্যান্ডের মতো প্রতিবেশী দেশে ইতোমধ্যে এমন সুবিধা চালু হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে সেসব প্রযুক্তি দেশে আনার চেষ্টাও চলমান।

পুরো যাত্রাপথে মাল্টিডিসিপ্লিনারি পদ্ধতির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি এবং টার্গেটেড থেরাপির সাথে রেডিয়েশন থেরাপি সংমিশ্রণে “কম্বিনেশন থেরাপি” গঠন করা হয়েছে, যা রোগীর সার্বিক যত্নকে আরও ফলপ্রসূ করে তুলেছে। পাশাপাশি বিকিরণ নিরাপত্তা নিয়ম, ডোজ ভলিউম কনস্ট্রেইন্ট এবং রেডিয়েশনের দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি মূল্যায়নেও উন্নত নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে।

সার্বিকভাবে বিকিরণ চিকিৎসার বিবর্তনে দেখা যায় প্রযুক্তির সাথে সাথে রোগীর নিরাপত্তা, আরাম, এবং সেবা প্রসারিত হয়েছে। প্রাথমিক ভারী ও অপরিকল্পিত মেশিন থেকে আধুনিক লিনাক, IMRT, IGRT, HDR ব্র্যাকিথেরাপি এবং ভবিষ্যতে প্রোটন থেরাপি—প্রতিটি ধাপে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশে রেডিয়েশন অনকোলজলোজির উন্নত স্বীকৃতি পেতে, প্রশিক্ষণ, ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে আরও উচ্চমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমে রোগীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সর্বোত্তম বিকিরণ চিকিৎসা উপলব্ধ হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *