ক্যান্সার এক জটিল ও বহুমাত্রিক রোগ, যা বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। যদিও এটি আতঙ্কের নাম, কিন্তু বর্তমান যুগে ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা, প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নতির ফলে এই রোগ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণযোগ্য হয়ে উঠেছে। নিচে ক্যান্সার নিয়ে ৩০টি তথ্য তুলে ধরা হলো, যা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকর্মী সকলের জানা প্রয়োজন।
১. ক্যান্সার থেকে বেঁচে যাওয়া সম্ভব
বর্তমানে বিশ্বে ২৮ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও দিব্যি বেঁচে আছেন। এটি চিকিৎসা ও সচেতনতার অগ্রগতির একটি বড় প্রমাণ।
২. এইচপিভি ভাইরাস ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার
এইচপিভি (HPV) বা হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস হল বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত যৌনবাহিত ভাইরাস। এটি জরায়ুমুখ ক্যান্সারের মূল কারণ হলেও, অনেক নারী আক্রান্ত হলেও ক্যান্সার পর্যন্ত গড়ায় না।
৩. বয়সের সঙ্গে ঝুঁকি বাড়ে
প্রায় ৭৭% ক্যান্সার রোগীর বয়স ৫৫ বছরের বেশি। অর্থাৎ, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ে, তাই প্রবীণদের নিয়মিত স্ক্রিনিং জরুরি।
৪. চেরনোবিল বিপর্যয় ও ক্যান্সার
চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা ইতিহাসের একক বৃহত্তম ক্যান্সার বৃদ্ধির ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা কিভাবে মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে, তা এখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে।
৫. ত্বক ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি
বিশ্বজুড়ে ত্বক ক্যান্সার বাড়ছে। বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন রোদে কাজ করা, কৃষিকাজ বা নিরাপত্তাহীন অবস্থায় বাইরে থাকা মানুষের মধ্যে ত্বক ক্যান্সারের ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে। সানস্ক্রিন ব্যবহার ও রোদে কম থাকা হতে পারে প্রতিরোধের একটি উপায়।
৬. এইচপিভি ভ্যাকসিন: গার্ডাসিল
গার্ডাসিল বা প্যাপিলোভ্যাক্স এর মতো ভ্যাকসিন জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর। ২০০৯ সাল থেকে বিশ্বে ৪ কোটির বেশি গার্ডাসিল ভ্যাক্সিন ডোজ বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশেও এখন এই ভ্যাকসিন পর্যায়ক্রমে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছে।
৭. মুখ ও দাঁতের যত্ন জরুরি
নিয়মিত দাঁত ব্রাশ না করলে মাড়ির প্রদাহ (জিঞ্জিভাইটিস) হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে মৌখিক ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৮. কিছু ক্যান্সার কমছে, কিছু বাড়ছে
বিশ্বে কলোরেক্টাল, জরায়ুমুখ ও ফুসফুস ক্যান্সার কিছুটা কমলেও লিভার, থাইরয়েড, কিডনি ও ত্বক ক্যান্সার বাড়ছে। খাদ্যাভ্যাস, দূষণ ও জীবনযাত্রার কারণে এই পরিবর্তন ঘটছে।
৯. স্বাস্থ্য বৈষম্য ও ক্যান্সার
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ক্যান্সারের পরিসংখ্যানে বৈষম্য রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্যান্সার হলে অনেক সময় চিকিৎসা পায় না, ফলে মৃত্যুহারও বেশি।
১০. হেনরিয়েটা ল্যাকস ও হিলা কোষ
হেনরিয়েটা ল্যাকস নামক এক নারীর জরায়ুমুখ ক্যান্সার থেকে সংগ্রহ করা কোষ আজকের বিশ্বখ্যাত ‘হিলা সেল লাইন‘, যা চিকিৎসা গবেষণায় বিপ্লব এনেছে—তবে তার সম্মতি ছাড়াই তা করা হয়েছিল।
১১. ক্যান্সারের অর্থনৈতিক বোঝা
বিশ্বে ক্যান্সারজনিত ব্যয় প্রতিবছর শত শত বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশেও একটি ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা খরচ প্রায়শই একটি পরিবারের সব সঞ্চয় শেষ করে দেয়।
১২. গবেষণায় হস্তক্ষেপ
কিছু বহুজাতিক কোম্পানি ও রাজনৈতিক প্রভাবে তামাক, বেনজিন ইত্যাদির ক্যান্সারজনিত প্রভাব নিয়ে গবেষণায় অনিয়ম ও তথ্য গোপন করা হয়েছে।
১৩. শিশু ক্যান্সার
প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় তিন লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, এবং হাজার হাজার শিশু চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে শিশু ক্যান্সারের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা এখনও সীমিত।
১৪. প্রতিরোধযোগ্য ক্যান্সার
বিশ্বের অর্ধেকের বেশি ক্যান্সার সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য, যদি আমরা সচেতন হই এবং ধূমপান, মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস পরিহার করি।
১৫. ক্যান্সারের প্রাচীন ইতিহাস
১৬০০ খ্রিস্টপূর্বে মিশরে লেখা এডউইন স্মিথ প্যাপিরাসে স্তন ক্যান্সারের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন “ফায়ার ড্রিল” দিয়ে চিকিৎসা করা হত।
১৬. ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস ও কারণ
তেজস্ক্রিয়তা, তামাক, দূষণ, অলস জীবনধারা এবং সংক্রমণ—এসবই ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
১৭. পুরুষ বনাম নারী: ক্যান্সারের ধরন
বিশ্বে পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায় স্টমাক, ফুসফুস ও প্রোস্টেট ক্যান্সার। নারীদের মধ্যে ব্রেস্ট, জরায়ুমুখ ও কলোরেক্টাল ক্যান্সার বেশি হয়।
১৮. সংক্রমণ ও ক্যান্সার
বিশ্বের প্রায় ১৫% ক্যান্সার সংক্রমণজনিত, যেমন HPV, হেপাটাইটিস বি/সি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই হার আরও বেশি।
১৯. “ক্যান্সার” নামের উৎপত্তি
“ক্যান্সার” শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘কারকিনোস’ থেকে, যার মানে কাঁকড়া। ক্যান্সার কোষের আকার কাঁকড়ার মতো ছড়ানো বলে এই নামকরণ।
২০. ভাইরাস ও প্রোস্টেট ক্যান্সার
২০০৬ সালে বিজ্ঞানীরা XMRV ভাইরাস আবিষ্কার করেন, যা প্রোস্টেট ক্যান্সারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে ধারণা করা হয়।
২১. স্তন ক্যান্সার ও সচেতনতা
স্তন ক্যান্সার হলো নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হওয়া ক্যান্সার। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৪.৫ লাখ নারী এ রোগে প্রাণ হারান। নিয়মিত চেকআপ জীবন বাঁচাতে পারে।
২২. মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ
বিশ্বে মৃত্যুর প্রথম কারণ হৃদরোগ, আর দ্বিতীয় কারণ ক্যান্সার। বাংলাদেশেও হার্ড অ্যাটাকের পরেই ক্যান্সার মৃত্যুর একটি বড় কারণ।
২৩. ভবিষ্যতের ভয়াবহতা
২০০৮ সালের মৃত্যুহার অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ২ কোটিরও বেশি নতুন ক্যান্সার রোগী হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২৪. ক্যান্সার চিহ্নিত করার উপায়
কোনো কোষ যদি অস্বাভাবিকভাবে বিভাজিত হয় এবং দেহের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেটিই ক্যান্সার।
২৫. বৈশ্বিক ক্যান্সার ভার
বিশ্বে প্রতি ৮ জনে ১ জন মৃত্যু ক্যান্সারজনিত, যা এইডস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার সম্মিলিত মৃত্যুর চেয়েও বেশি।
২৬. কোষ বিভাজনের বিপর্যয়
ক্যান্সার কোষ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিভাজিত হয়, ফলে স্বাভাবিক কোষ ধ্বংস হয় এবং দেহ দুর্বল হতে থাকে।
২৭. প্রক্রিয়াজাত খাবারের বিপদ
হটডগ, সসেজ, প্রক্রিয়াজাত মাংস—এসব খাবারে থাকা নাইট্রেট দেহে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক তৈরি করতে পারে।
২৮. ধূমপান: ক্যান্সারের মূল ঘাতক
৯০% ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য ধূমপান দায়ী। বিগত ১০ বছরে এর জন্য ৫ কোটিরও বেশি মৃত্যু ঘটেছে। ধূমপান ছাড়াই ক্যান্সার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ।
২৯. ঘুমের অভাব ও ক্যান্সার
দিনে ৬ ঘণ্টার কম ঘুম দীর্ঘমেয়াদে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ঘুম স্বাস্থ্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
৩০. বংশগত কারণ
সুস্থ জীবনযাপন করলেও কেউ কেউ জিনগত কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সব ক্যান্সারের মধ্যে ৫-১০% ক্যান্সার বংশগত।