ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত: টি-সেল থেরাপির যুগান্তকারী আবিষ্কার

ক্যান্সারের নিরাময়ের খোঁজ চলছে বহুদিন ধরেই। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় এক নতুন আশার আলো দেখা যাচ্ছে। আজকে লিখছি ক্যান্সারবিরোধী লড়াইয়ের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং টি-সেল থেরাপির যুগান্তকারী সাফল্য নিয়ে। পড়বার জন্য তৈরী তো?

 

. টিসেল থেরাপি কী?

টি-সেল থেরাপি হলো একধরনের ইমিউনোথেরাপি, যেখানে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ ধ্বংসে কাজে লাগানো হয়। এটি অনেক বিশেষজ্ঞের চোখে ক্যান্সার চিকিৎসায় পঞ্চম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত—সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন ও টার্গেটেড থেরাপির পাশাপাশি।

এই থেরাপিতে শরীরের টি-সেল নামক শ্বেত রক্তকণিকাকে জেনেটিকভাবে পরিবর্তন করে এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেন তারা ক্যান্সার কোষের গায়ে থাকা “অ্যান্টিজেন” নামক দুর্বল অংশগুলোকে চিনে নিয়ে ধ্বংস করতে পারে। গবেষকরা ক্যান্সার বৃদ্ধিকে একটি গাছের সাথে তুলনা করেছেন, যার ডালপালা ছড়িয়ে যায়, কিন্তু মূল কাণ্ডই সব সমস্যার কেন্দ্র। আর এই থেরাপি সেই মূল কাণ্ডকে আঘাত করে গোড়া থেকেই সমস্যাকে নির্মূল করার চেষ্টা করে।

 

. কারা এই গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন?

এই গবেষণায় যুক্ত রয়েছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ডেনমার্কের বিজ্ঞানীরা। মূল অর্থায়ন করেছে ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের ড. সার্জিও কাসাদা একে তাঁর জীবনের “সবচেয়ে বিস্ময়কর সহযোগিতা” বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর অধ্যাপক চার্লস সুয়ানটন বলেন, এই থেরাপি ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাতে পারে।

ড. স্ট্যানলি রিডেল, যিনি সিয়াটলের ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে এই চিকিৎসা নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজ শুরু করেন ২০১৬ সালে, ২৯ জন দুরারোগ্য লিউকেমিয়া রোগীর ওপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ৯৩% ক্ষেত্রে পূর্ণ সাফল্য লাভ করেন। আশার কথা হলো বাংলাদেশেও এই থেরাপি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের গবেষণা চলছে। গ্লোব বায়েটেকের ল্যাব ঘুরে দেখার প্রেক্ষিতে আমি বলতে পারি যে যথাযথ পলিসি সহায়তা পেলে বাংলাদেশও এই ধরনের চিকিৎসা উন্নয়নে সাড়া জাগানো সাফল্য দেখাতে সক্ষম হবে।

. ভবিষ্যতে কী ধরনের চিকিৎসা আসতে পারে?

ড. কাসাদা জানিয়েছেন, এই গবেষণার ফলাফল দুটি সম্ভাব্য চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বার উন্মোচন করতে পারে—

  • ব্যক্তিগতকৃত ক্যান্সার ভ্যাকসিন: প্রতিটি রোগীর ক্যান্সার প্রোফাইল অনুযায়ী তৈরি ভ্যাকসিন, যা খুব কার্যকর হতে পারে।
  • টার্গেটেড টিসেল তৈরি: রোগীর শরীর থেকে টি-সেল সংগ্রহ করে বাইরে অনেকগুণ বৃদ্ধি করে আবার শরীরে প্রবেশ করানো হয়, যাতে তারা ক্যান্সার কোষগুলোকে শক্তিশালীভাবে আক্রমণ করতে পারে।

তবে এদের দুটিরই সীমাবদ্ধতা রয়েছে—যেমন সময়সাপেক্ষতা ও উচ্চ ব্যয়।

 

. রোগীদের ফলাফল কী ছিল?

যদিও এই চিকিৎসা এখনও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না, প্রাথমিক পরীক্ষাগুলো বেশ আশাব্যঞ্জক। যেমন, রিডেলের পরীক্ষায় ৩০ জন নন-হজকিনস লিম্ফোমা রোগীর মধ্যে ৬৫% রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন রোগীর উপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল ফল পাওয়া গেছে।

এমন অনেক রোগী ছিলেন যাদের চিকিৎসা আর সম্ভব ছিল না, কিন্তু টি-সেল থেরাপির মাধ্যমে তাঁরা সুস্থ হয়েছেন। ড. রেনিয়ের ব্রেনিনের মতে, এই গবেষণা “প্রমাণ করে যে আমরা সফলভাবে রোগীর টি-সেলকে পরিবর্তন করে ক্যান্সার কোষকে লক্ষ্য করতে পারি।”

 

. এই আবিষ্কারের গুরুত্ব কী?

টি-সেল থেরাপি এখনও ক্যান্সারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নয়, তবে এটি নিঃসন্দেহে এক বিরাট অগ্রগতি। গবেষণার শুরুতেই আমরা এমন এক পথ দেখছি, যা ভবিষ্যতে লাখো মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। অধ্যাপক সুয়ানটন নিজেই বলেছেন, “আমরা আশাবাদী, তবে বাস্তববাদী। সামনে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।”

যদিও এই পথ নতুন এবং কিছুটা অনিশ্চিত, তথাপি এটি এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *