হোমিওপ্যাথি ও ক্যান্সার চিকিৎসা

হোমিওপ্যাথি ও ক্যান্সার চিকিৎসা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলেছে। অনেক রোগী এটি সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে বেছে নিলেও, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, হোমিওপ্যাথি ক্যান্সার নিরাময়ে কার্যকর নয়। এই প্রবন্ধে আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার আলোকে হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করব।

 

হোমিওপ্যাথির মৌলিক ধারণা

 

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির জনক ছিলেন জার্মান চিকিৎসক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান, যিনি ১৭৫৫ সালের ১০ই এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৭৯৬ সালে “সম রোগে সম ঔষধ” নীতির ভিত্তিতে হোমিওপ্যাথির সূচনা করেন। হ্যানিম্যান ছিন্না গাছের (সাধারণত বোঝানো হয় এমন এক ধরনের উদ্ভিদ যা খুব নরম ডাঁটা বা কান্ডযুক্ত এবং সহজেই ছিঁড়ে যায়) ছাল (কুইনাইন) নিজের উপর প্রয়োগ করে আবিষ্কার করেন যে যে উপাদান কোনো সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে কোনো লক্ষণ সৃষ্টি করে, সেই উপাদানই রোগীর সেই একই লক্ষণ নিরাময়ে সহায়ক হতে পারে। এই তত্ত্ব থেকেই হোমিওপ্যাথির মূল ভিত্তি গড়ে ওঠে। তার লেখা “Organon of Medicine” বইটি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার মূলগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত। হ্যানিম্যান বিশ্বাস করতেন, রোগের প্রকৃত নিরাময় মৃদু, প্রাকৃতিক ও রোগের মূল কারণ অনুযায়ী হওয়া উচিত। ১৮৪৩ সালে তার মৃত্যু হয়।, তাঁর আবিষ্কৃত হোমিওপ্যাথি বিশ্বের বহু দেশে চর্চিত হলেও , এই পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে (Linde et al., 2001)।

 

ক্যান্সার চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির ভূমিকা

১. বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর্যালোচনা
একটি সিস্টেমেটিক রিভিউতে দেখা গেছে, হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা প্রমাণ করার মতো উচ্চমানের গবেষণা খুবই সীমিত। বেশিরভাগ গবেষণাই ছোট পরিসরের এবং পদ্ধতিগত দুর্বলতায় ভরা। এতে হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা নিয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন (Mathie et al., 2014)।

২. ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি, হোমিওপ্যাথিকে ক্যান্সার চিকিৎসায় কার্যকর হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তাদের মতে, হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা প্রমাণ করার মতো নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই (American Cancer Society, 2008)।

৩. সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে হোমিওপ্যাথি
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, হোমিওপ্যাথি কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে সহায়ক হতে পারে। তবে, এই গবেষণাগুলোর নমুনা আকার ছোট এবং পদ্ধতিগত দুর্বলতা রয়েছে, যা ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে (Ernst, 2005)।

 

বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থান

বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য সংস্থা ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (NHMRC) ২০১৫ সালে একটি পর্যালোচনায় জানিয়েছে যে, হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা প্রমাণ করার মতো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই (NHMRC, 2015)।

 

নৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত বিষয়

হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা প্রমাণিত না হওয়ায়, এটি ব্যবহার করে প্রমাণিত চিকিৎসা পদ্ধতি এড়িয়ে চলা রোগীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, হোমিওপ্যাথির উপর নির্ভর করে প্রমাণিত চিকিৎসা বিলম্বিত করলে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে (Ernst, 2005)।

 

শেষ কথা

বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, হোমিওপ্যাথি ক্যান্সার নিরাময়ে কার্যকর নয়। তবে, কিছু রোগী এটি সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করে উপকার পেতে পারেন। তবে, হোমিওপ্যাথিকে প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করা ঝুঁকিপূর্ণ। রোগীদের উচিত প্রমাণিত চিকিৎসা পদ্ধতির উপর নির্ভর করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করা।

 

তথ্যসূত্রঃ

American Cancer Society. (2008). Homeopathy.

Ernst, E. (2005). Efficacy of homeopathic therapy in cancer treatment. European Journal of Cancer, 41(5), 748–753.

Linde, K., et al. (2001). Are the clinical effects of homoeopathy placebo effects? Comparative study of placebo-controlled trials of homoeopathy and allopathy. The Lancet, 366(9487), 726–732.

Mathie, R.T., et al. (2014). Randomised placebo-controlled trials of individualised homeopathic treatment: systematic review and meta-analysis. Systematic Reviews, 3, 142.

National Health and Medical Research Council (NHMRC). (2015). NHMRC Information Paper: Evidence on the effectiveness of homeopathy for treating health conditions.

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *