২০১৮ সালের শুরুর দিকে, ক্যাথি উইলকস যখন জানতে পারলেন যে তিনি স্টেজ-থ্রি বা তৃতীয় পর্যায়ের অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত, তখন তার পৃথিবীটা যেন এক লহমায় থমকে গিয়েছিল। বাঁচার আশা কতটা, তা তিনি জানতেন না। চিকিৎসকরা প্রথাগত সবরকম চেষ্টা করেছিলেন—আটটি কেমোথেরাপির কষ্টকর চক্র, জটিল অস্ত্রোপচার এবং রেডিয়েশন থেরাপি। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। পরের বছরের মধ্যেই ক্যান্সার তার ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে, যা মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সার নামে পরিচিত এবং এর চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করা হতো।
প্রচলিত সব চিকিৎসা পদ্ধতি যখন ব্যর্থ, তখন ক্যাথি এক যুগান্তকারী পরীক্ষামূলক চিকিৎসার কথা জানতে পারেন। তিনি ফ্লোরিডা থেকে সুদূর পোর্টল্যান্ডে পাড়ি জমান শুধুমাত্র এই চিকিৎসার জন্য। আর সেখানেই ঘটে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা, যা শুধু ক্যাথির জীবনকেই বদলে দেয়নি, বরং ক্যান্সার চিকিৎসার ভবিষ্যৎ নিয়েও নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
‘জীবন্ত ঔষধ’: বিজ্ঞানের নতুন বিস্ময়
এই যুগান্তকারী চিকিৎসা পদ্ধতির মূলে রয়েছে ‘অ্যাডপটিভ সেল থেরাপি’ বা টি-সেল থেরাপি, যাকে বিজ্ঞানীরা ‘জীবন্ত ঔষধ’ বলে অভিহিত করছেন। এই পদ্ধতিতে রোগীর শরীর থেকেই তার রোগ প্রতিরোধক কোষ, অর্থাৎ টি-সেল সংগ্রহ করা হয়। টি-সেল হলো আমাদের শরীরের সেই প্রাকৃতিক যোদ্ধা, যা বাইরের জীবাণু এবং অস্বাভাবিক কোষকে ধ্বংস করে। কিন্তু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে, এই কোষগুলো প্রায়শই দুর্বল হয়ে পড়ে অথবা ক্যান্সার কোষকে শত্রু হিসেবে চিনতে পারে না।
ওরেগনের প্রভিডেন্স ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের গবেষক ডঃ এরিক ট্রান এবং তার সহকর্মীরা এই সমস্যার এক অভিনব সমাধান বের করেছেন। তারা ক্যাথির রক্ত থেকে টি-সেল সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে সেগুলোর জেনেটিক পরিবর্তন ঘটান। এই প্রক্রিয়ায় টি-সেলগুলোকে এমনভাবে নতুন করে সাজানো হয়, যাতে তারা বিশেষভাবে ক্যাথির টিউমারে থাকা একটি নির্দিষ্ট মিউটেশন, যা ‘কেআরএএস জি১২ডি’ নামে পরিচিত, তাকে নিখুঁতভাবে শনাক্ত এবং আক্রমণ করতে পারে।
এরপর এই বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী কোটি কোটি টি-সেল ক্যাথির শরীরে আবার প্রবেশ করানো হয়। ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। মাত্র এক মাসের মধ্যে তার ফুসফুসের টিউমারগুলো ৬০ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়ে যায় এবং ছয় মাসের মধ্যে ৭২ শতাংশ কমে যায়। বর্তমানে তার ক্যান্সার স্থিতিশীল এবং তিনি তার ৭২তম জন্মদিন উদযাপন করছেন, যা একসময় কল্পনারও অতীত ছিল।
কেন এই চিকিৎসা এত গুরুত্বপূর্ণ?
অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হিসেবে দেখা হয়। এর কারণ হলো, এই রোগটি খুব দেরিতে ধরা পড়ে এবং প্রচলিত চিকিৎসায় ভালোভাবে সাড়া দেয় না। বিশেষ করে, যখন এটি শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে (মেটাস্ট্যাটিক), তখন রোগীর বেঁচে থাকার হার অত্যন্ত কম থাকে—পাঁচ বছরের বেঁচে থাকার হার মাত্র ২ থেকে ১০ শতাংশ। ক্যাথির ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, মেটাস্ট্যাটিক অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধেও কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব।
এই গবেষণার ফলাফলটি বিখ্যাত ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন’-এ প্রকাশিত হয়েছে, যা এর বৈজ্ঞানিক গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ডঃ ট্রান এবং তার দল দেখিয়েছেন যে, কেবল একটি মাত্র ইনফিউশনের মাধ্যমে রোগীর শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে ক্যান্সারের মতো কঠিন রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই পদ্ধতিকে ‘একবারের চিকিৎসা’ হিসেবেও ভাবা হচ্ছে, কারণ শরীরে প্রবেশ করানোর পর এই পরিবর্তিত কোষগুলো থেকে যায় এবং ভবিষ্যতে ক্যান্সার ফিরে এলে আবারও লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকে।
অন্যান্য ক্যান্সারের জন্যেও কি এটি আশার আলো?
এই গবেষণার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দিকটি হলো, এটি শুধু অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে। ক্যাথির শরীরে যে ‘কেআরএএস’ মিউটেশনকে লক্ষ্য করে এই চিকিৎসা করা হয়েছিল, সেটি অন্যান্য অনেক ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। প্রায় ৯৫ শতাংশ অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে, ৪০ শতাংশ কোলন ক্যান্সারে এবং ৩৩ শতাংশ ফুসফুসের ক্যান্সারে এই একই মিউটেশন পাওয়া যায়।
এর অর্থ হলো, যে নীতিতে ক্যাথির চিকিৎসা সফল হয়েছে, সেই একই নীতি প্রয়োগ করে কোলন, ফুসফুস, প্রোস্টেট এবং স্তন ক্যান্সারের মতো কঠিন রোগগুলোর চিকিৎসাতেও বিপ্লব আনা সম্ভব হতে পারে। গবেষকরা মনে করছেন, ক্যাথির এই সাফল্য প্রমাণ করে যে এই পথে হাঁটা সম্ভব। এটি ক্যান্সার গবেষণার জগতে এক বিশাল পদক্ষেপ।
ভবিষ্যৎ পথচলা ও সতর্কতা
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই চিকিৎসা এখনও অত্যন্ত পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে এবং এটি ব্যাপকভাবে উপলব্ধ হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। ক্যাথির ক্ষেত্রে এটি একটি একক রোগীর ওপর করা ট্রায়াল ছিল, যা বিশেষভাবে তার জন্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) দ্বারা অনুমোদিত হয়েছিল। গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে, একই ধরনের চিকিৎসায় অন্য একজন রোগী সাড়া দেননি, যা প্রমাণ করে যে পথটি এখনও দীর্ঘ এবং জটিল।
এই পদ্ধতির কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আরও বড় আকারের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রয়োজন। ডঃ ট্রান এবং তার দল ইতোমধ্যে ২৪ জন নতুন রোগীকে নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু করার পরিকল্পনা করছেন।
ক্যাথি উইলকসের এই অদম্য লড়াই এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই যুগান্তকারী উদ্ভাবন আজ লক্ষ লক্ষ ক্যান্সার রোগী এবং তাদের পরিবারের জন্য এক নতুন আশার আলো। এটি আমাদের দেখায় যে, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে একদিন হয়তো ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিকেও পরাজিত করা সম্ভব হবে, আর সেই লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় অস্ত্রটি হয়তো লুকিয়ে আছে আমাদের নিজেদের শরীরের ভেতরেই।