ক্যান্সার যখন তার উৎপত্তিস্থল থেকে শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা রোগীর জন্য এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে। বিশেষত, যখন অ্যাপেন্ডিক্স, মলাশয় বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার পেটের ভেতরের ফাঁকা স্থান বা পেরিটোনিয়াল গহ্বরে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাকে পেরিটোনিয়াল মেটাস্টেসিস বলা হয়। এই পর্যায়ে পৌঁছানো ক্যান্সারকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন এবং প্রচলিত কেমোথেরাপি এক্ষেত্রে প্রায়শই সীমিত সাফল্য দেখায়। তবে, এই হতাশাজনক পরিস্থিতির মাঝে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন আশার আলো নিয়ে এসেছে, যার নাম সাইটোরেডাক্টিভ সার্জারি (CRS) এবং হাইপেক (HIPEC) থেরাপি।
সমস্যার গভীরতা: অদৃশ্য শত্রুর বিস্তার
পেটের ভেতরের গহ্বরকে একটি বাগানের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ক্যান্সার কোষগুলো হলো আগাছার বীজের মতো। মূল টিউমার থেকে এই “বীজ” বা ক্যান্সার কোষগুলো যখন পেরিটোনিয়াল গহ্বরে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তারা বিভিন্ন অঙ্গে বাসা বাঁধে এবং নতুন টিউমার তৈরি করে। এই ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সার কোষগুলো খালি চোখে দেখা প্রায় অসম্ভব। সাধারণ শিরায় দেওয়া কেমোথেরাপি এই নির্দিষ্ট অঞ্চলে যথেষ্ট ঘনত্বে পৌঁছাতে পারে না, ফলে এর কার্যকারিতা কমে যায়। এখানেই CRS এবং হাইপেকের সম্মিলিত শক্তির প্রয়োজন হয়।
দুই ধাপের সমন্বিত চিকিৎসা: CRS ও হাইপেক
এই চিকিৎসা পদ্ধতিটি মূলত একটি বড় অপারেশনের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে এটি ক্যান্সার নির্মূলে সর্বোচ্চ সাফল্য নিশ্চিত করে।
প্রথম ধাপ: সাইটোরেডাক্টিভ সার্জারি (CRS)
এই চিকিৎসার প্রথম এবং সবচেয়ে দীর্ঘ পর্যায় হলো সাইটোরেডাক্টিভ সার্জারি। এর মূল লক্ষ্য হলো পেটের গহ্বরের ভেতর থেকে খালি চোখে দৃশ্যমান সমস্ত টিউমার এবং ক্যান্সার আক্রান্ত অংশ সম্পূর্ণরূপে অপসারণ করা। এটি একটি অত্যন্ত জটিল এবং সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার। সার্জনদের অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অন্ত্র, যকৃতের অংশ, ডায়াফ্রাম এবং পেরিটোনিয়ামের আস্তরণ থেকে ক্যান্সারের প্রতিটি কণা খুঁজে বের করে বাদ দিতে হয়। এই ধাপের সাফল্যই পরবর্তী ধাপের কার্যকারিতার ভিত্তি তৈরি করে। সোজা কথায়, CRS দৃশ্যমান শত্রুকে সমূলে বিনাশ করে।
দ্বিতীয় ধাপ: হাইপেক (HIPEC)
সাইটোরেডাক্টিভ সার্জারির মাধ্যমে দৃশ্যমান টিউমার অপসারণের পরেই শুরু হয় হাইপেকের কাজ। হাইপেক (Hyperthermic Intraperitoneal Chemotherapy) হলো এক বিশেষ ধরনের “উষ্ণ কেমোথেরাপির স্নান”। অস্ত্রোপচার শেষ হওয়ার পর, অপারেটিং থিয়েটারেই একটি বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে উত্তপ্ত (প্রায় ৪২° সেলসিয়াস) কেমোথেরাপির দ্রবণ সরাসরি রোগীর পেটের গহ্বরে প্রবেশ করানো হয় এবং প্রায় ৯০ মিনিট ধরে তা সঞ্চালন করা হয়।
এর দুটি প্রধান সুবিধা রয়েছে:
১. উচ্চ তাপমাত্রা: উত্তাপ ক্যান্সার কোষগুলোকে দুর্বল করে দেয় এবং কেমোথেরাপির প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তোলে।
২. সরাসরি প্রয়োগ: কেমোথেরাপি সরাসরি আক্রান্ত স্থানে প্রয়োগ করার ফলে শিরায় দেওয়ার চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ বেশি ঘনত্বের ওষুধ ব্যবহার করা সম্ভব হয়, অথচ এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে না।
হাইপেক সেই সব আণুবীক্ষণিক ও অদৃশ্য ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করে, যা সার্জারির পরেও পেছনে থেকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এভাবে, CRS এবং হাইপেক একসাথে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য উভয় শত্রুকে নির্মূল করে।
কারা এই চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত?
এই উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতিটি সবার জন্য নয়। এর সাফল্যের জন্য রোগী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়:
- শারীরিক সক্ষমতা: এটি একটি দীর্ঘ এবং বড় অস্ত্রোপচার, তাই রোগীর শারীরিক অবস্থা যথেষ্ট মজবুত হতে হয়।
- ক্যান্সারের ধরন: এই পদ্ধতিটি নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর, যেমন—অ্যাপেন্ডিক্সের ক্যান্সার, কোলোরেক্টাল ক্যান্সার এবং মেসোথেলিওমা।
- রোগের বিস্তৃতি: ক্যান্সারটি অবশ্যই পেটের গহ্বরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। ফুসফুস, মস্তিষ্ক বা হাড়ের মতো দূরবর্তী অঙ্গে ছড়িয়ে গেলে এই চিকিৎসা কার্যকর হয় না।
- টিউমারের আয়তন: পেটের ভেতরে টিউমারের পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকতে হবে। অতিরিক্ত ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের ক্ষেত্রে সার্জারির পরেও পুনরায় রোগ ফিরে আসার ঝুঁকি বেশি থাকে।
ফলাফল ও সম্ভাবনা
সঠিকভাবে নির্বাচিত রোগীর ক্ষেত্রে এই চিকিৎসার ফলাফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে:
- পেরিটোনিয়াল মেটাস্টেসিসে আক্রান্ত রোগী কোনো চিকিৎসা না পেলে গড়ে ৬-৮ মাস বাঁচেন।
- শুধুমাত্র শিরায় কেমোথেরাপি নিলে গড় আয়ু বেড়ে প্রায় ১৬ মাস হয়।
- বিপরীতে, সাইটোরেডাক্টিভ সার্জারি ও হাইপেক গ্রহণকারী রোগীদের গড় আয়ু ৪২ মাস বা তারও বেশি হতে পারে।
এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে, এই সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতিটি ক্যান্সার রোগীদের জীবনে কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
শেষ কথা
সাইটোরেডাক্টিভ সার্জারি এবং হাইপেক নিঃসন্দেহে পেরিটোনিয়াল মেটাস্টেসিসের চিকিৎসায় একটি বিপ্লব এনেছে। এটি একটি জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি, যার জন্য প্রয়োজন একটি অভিজ্ঞ মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম এবং বিশেষায়িত কেন্দ্র। তবে সঠিক রোগীর জন্য এটি কেবল আয়ু বাড়ায় না, বরং জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এক নতুন আশার সঞ্চার করে। ক্যান্সার গবেষণার অগ্রগতির সাথে সাথে এই ধরনের আঞ্চলিক থেরাপিগুলো ভবিষ্যতে আরও কার্যকর এবং নিরাপদ হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।