বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (বিএমটি), যাকে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বলা হয়, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এটি রক্ত সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল ও প্রাণঘাতী রোগের, বিশেষতঃ ক্যান্সার, লিউকেমিয়া, থ্যালাসেমিয়া ও কিছু জেনেটিক রোগের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এই চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষের মাঝে এখনো অনেক ভুল ধারণা রয়েছে, যা শুধুমাত্র তথ্যের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট কী?
বোন ম্যারো হলো আমাদের শরীরের হাড়ের ভেতরে থাকা নরম টিস্যু, যেখানে রক্তকণিকার উৎপত্তি হয়। এই টিস্যুতে থাকা হেমাটোপোয়েটিক স্টেম সেলস (HSCs) থেকেই লাল রক্তকণিকা, সাদা রক্তকণিকা ও প্লেটলেট তৈরি হয়। যখন এই কোষগুলো ক্যান্সার বা অন্য কোনো রোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন সুস্থ কোষ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে রোগীকে পুনরায় সুস্থ করার জন্য বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়।
বিএমটি-র প্রকারভেদ
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট প্রধানত দুই প্রকারের হয়ে থাকে, যা নির্ভর করে স্টেম সেল সংগ্রহের উৎসের ওপর।
- অটোলোগাস ট্রান্সপ্লান্ট (Autologous Transplant): এই পদ্ধতিতে রোগীর নিজের শরীর থেকেই স্টেম সেল সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত, ক্যান্সারের জন্য উচ্চ-মাত্রার কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি দেওয়ার আগে রোগীর শরীর থেকে সুস্থ স্টেম সেল সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয়। চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর সেই সংরক্ষিত স্টেম সেল আবার রোগীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়, যা নতুন করে সুস্থ রক্তকণিকা তৈরি করতে সাহায্য করে।
- অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্লান্ট (Allogeneic Transplant): এই পদ্ধতিতে অন্য কোনো সুস্থ ব্যক্তির (ডোনার) শরীর থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করে রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। ডোনার সাধারণত রোগীর পরিবারের সদস্য বা অন্য কোনো ব্যক্তি হতে পারেন, যার টিস্যু টাইপ (HLA) রোগীর সাথে মিলে যায়। এই ধরণের ট্রান্সপ্লান্ট বেশ জটিল এবং এর সাফল্যের জন্য ডোনার ও রোগীর মধ্যে মিল থাকা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া, সিনজেনিক ট্রান্সপ্লান্ট (Syngeneic Transplant) নামে অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্লান্টের একটি বিশেষ ধরণ আছে, যেখানে দাতা এবং গ্রহীতা উভয়েই অভিন্ন যমজ ভাই-বোন হন।
চিকিৎসা প্রক্রিয়া ও ধাপসমূহ
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট মূলত একটি দুই ধাপের প্রক্রিয়া। প্রথম ধাপে রোগীর দেহ থেকে ক্ষতিকর বা ক্যান্সারগ্রস্ত কোষ ধ্বংস করার জন্য কেমোথেরাপি ও কখনো কখনো রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। এটি মাটি প্রস্তুত করার মতো, যাতে সুস্থ কোষ সহজে গজাতে পারে। দ্বিতীয় ধাপে, ডোনারের শরীর থেকে সংগৃহীত সুস্থ স্টেম সেলস রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। এ কোষগুলো স্বাভাবিকভাবে রোগীর অস্থিমজ্জায় নিজে থেকেই গিয়েই বসে পড়ে এবং নতুন রক্তকণিকা উৎপাদন শুরু করে।
ডোনার নির্বাচন ও মিল
প্রতিস্থাপনের জন্য ডোনারকে রোগীর সাথে টিস্যু টাইপের (HLA টাইপিং) ক্ষেত্রে একেবারে মিল থাকতে হয়। এটি রক্তের গ্রুপের মতো সহজ নয়—বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ ভিন্ন টিস্যু টাইপ থাকায় একটি উপযুক্ত মিল পাওয়া অনেক সময় একেবারেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। একারণে পরিবারের বাইরে উপযুক্ত ডোনার খুঁজে পাওয়া কঠিন হলেও জরুরি।
ডোনার হওয়ার প্রক্রিয়া
অনেকেই ধারণা করেন, বোন ম্যারো ডোনেশন মানেই একটি বড় অপারেশন বা ভয়ংকর ব্যথাদায়ক প্রক্রিয়া। বাস্তবে তা নয়। বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্টেম সেল সংগ্রহের সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হলো ‘Peripheral Blood Stem Cell Donation’ (PBSC), যেখানে রক্তের মাধ্যমেই ডোনার থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করা হয়—একটি সাধারণ রক্তদান প্রক্রিয়ার মতোই। শুধুমাত্র কয়েকদিন আগেই কিছু ইনজেকশন দিয়ে ডোনারের শরীরে স্টেম সেলের উৎপাদন বাড়িয়ে নেওয়া হয়।
ভুল ধারণা ও আধুনিক বাস্তবতা
বিভিন্ন ভুল ধারনা যেমন—ট্রান্সপ্লান্ট মানেই অপারেশন, অত্যন্ত বয়স্ক হলে ট্রান্সপ্লান্ট করা যায় না, কিংবা এটি অত্যন্ত ব্যথাদায়ক—এগুলো আজকাল আর বাস্তবতার সঙ্গে মিলে না। এমনকি অনেক রোগী ট্রান্সপ্লান্টের সময় হাসপাতালে ভর্তি হনও না। বর্তমানে ৭০ বছরের বেশি বয়সের রোগীদেরও এই চিকিৎসা সফলভাবে দেওয়া হচ্ছে।
বাঁচার নতুন সুযোগ
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট অনেক রোগীর জন্য একটি দ্বিতীয় জীবন। অনেকেই এই চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী সুস্থতা কিংবা সম্পূর্ণ রোগমুক্তি লাভ করেছেন। একজন অজানা ডোনারের ছোট্ট একটি সিদ্ধান্ত—রেজিস্ট্রিতে নাম লেখানো—অপর একজনের জীবনে আনে প্রাণ ফেরানোর সম্ভাবনা।
উপসংহার
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট এখন আর কোনো আতঙ্ক নয় বরং এটি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর পদ্ধতি। এর সঠিক তথ্য, সচেতনতা এবং স্বেচ্ছায় ডোনার হওয়ার আগ্রহ সমাজে ছড়িয়ে দিলে, অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব। আমাদের প্রত্যেকের উচিত, এই জীবনদায়ী কাজে অংশ নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
জীবন উপহার দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। একটি রেজিস্ট্রেশন, একটি সিদ্ধান্ত—একটি জীবন।