ক্যান্সার ও হৃদরোগ কি সম্পর্কিত?

চিকিৎসাবিজ্ঞানে হাজার হাজার রোগের নাম নথিভুক্ত আছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সংখ্যাটা ষাট হাজারের বেশি। এমন অদ্ভুত রোগও তালিকায় পাওয়া যায়, যেমন – ওয়াটার স্কি করার সময় তাতে আগুন লেগে পুড়ে যাওয়া, কুকুরের কামড় খাওয়ার পর অস্ত্রোপচার, মহাকাশযানের সাথে ধাক্কা লাগা, অথবা শাশুড়ির সাথে চরম ঝামেলার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়া। 

এইসব অদ্ভুত ও মজাদার তথ্যের বাইরে একটি কঠিন সত্য আমাদের সামনে দাঁড়ায়। তা হলো, এই পৃথিবীতে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যু ঘটবে মাত্র দুটি রোগের কারণে – ক্যান্সার অথবা হৃদরোগ (কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ)। এই দুটি রোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা মারাত্মক এবং এদের বিরুদ্ধে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করা কতটা জরুরি, তা এই তথ্য থেকেই স্পষ্ট।

অনেকেই মনে করেন, এই দুটি রোগ যেহেতু সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, তাই তাদের মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকা সম্ভব নয়। তাদের ঝুঁকির কারণগুলো আলাদা, রোগের লক্ষণ ভিন্ন এবং আক্রান্ত রোগীর ধরনও আলাদা। উদাহরণস্বরূপ, একজন বৃদ্ধ ধূমপায়ী যিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন, তার সাথে একজন তরুণীর হঠাৎ করে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এই প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে। নতুন গবেষণা বলছে, এই দুই রোগের মধ্যে গভীর এবং বিস্ময়কর এক সম্পর্ক রয়েছে।

প্রচলিত ধারণার প্রাচীর ভেঙে নতুন ভাবনা

প্রথমে দেখা যাক, কেন এই দুটি রোগকে ভিন্ন ভাবা হয়। বহু বছর ধরে আমরা জেনে এসেছি যে, ধূমপান, উচ্চ কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস, এবং উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের প্রধান কারণ। অন্যদিকে, ক্যান্সারকে কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনের ফল হিসেবে দেখা হয়, যেখানে একটি টিউমার ধীরে ধীরে শরীরের কোনো অঙ্গকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। জিনগত দিক থেকেও এদের ভিন্ন ভাবা হতো। যেমন, স্তন ক্যান্সারের জন্য দায়ী জিনগুলোর সাথে হৃদরোগের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কিন্তু মানব জিনোম প্রকল্পের পর এই ধারণা বদলে যেতে শুরু করেছে। বিজ্ঞানীরা যখন পুরো জিনোম একসাথে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পেলেন, তখন এক যুগান্তকারী তথ্য সামনে এলো। দেখা গেল, হৃদরোগের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জিনটি ক্রোমোজোম ৯-এ অবস্থিত এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই জিনের সাথে ধূমপান বা কোলেস্টেরলের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। বরং, এটি এমন একটি পরিচিত ক্যান্সার জিনকে নিয়ন্ত্রণ করে যা মেলানোমা, মস্তিষ্কের ক্যান্সার এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো রোগে সক্রিয় থাকে। অর্থাৎ, জিনগত স্তরেই হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মধ্যে একটি গোপন সেতু আবিষ্কৃত হয়েছে।

শুধু জিনগত নয়, কোষীয় পর্যায়েও এই দুই রোগের মধ্যে মিল আশ্চর্যজনক। আগে মনে করা হতো, হৃদরোগ মানে ধমনীতে কোলেস্টেরল জমে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর ক্যান্সার মানে শুধু টিউমারের বৃদ্ধি। কিন্তু আধুনিক পাঠ্যবই বলছে, উভয় রোগেই প্রদাহ সৃষ্টিকারী কোষ, অস্বাভাবিক রক্তনালী এবং এমনকি স্টেম সেলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ফলে, আণুবীক্ষণিক স্তরেও রোগ দুটিকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

গবেষণাগার থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ

তাত্ত্বিক আলোচনার পর প্রশ্ন আসে, বাস্তব জীবনে এর কোনো প্রমাণ আছে কি? ইউরোপ এবং এশিয়ার একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব রোগী হার্ট ফেইলিউরের মতো হৃদরোগে ভুগছেন, তাদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায়, দুটি ঘটনার একসাথে ঘটা মানেই একটি অন্যটির কারণ নয়।

এই কার্যকারণ সম্পর্ক প্রমাণ করার জন্য এমন একটি পরীক্ষা দরকার, যেখানে একজন সুস্থ প্রাণীর দেহে ইচ্ছাকৃতভাবে হার্ট অ্যাটাক ঘটানো হবে এবং তারপর দেখা হবে তার শরীরে ক্যান্সারের হার বাড়ে কিনা। মানুষের উপর এমন পরীক্ষা অনৈতিক, কিন্তু গবেষণাগারে ইঁদুরের উপর এই পরীক্ষা করা হয়েছে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখা গেছে, সুস্থ ইঁদুরের তুলনায় যে ইঁদুরগুলোর হৃদরোগ ছিল, তাদের শরীরে ক্যান্সারের বৃদ্ধি অনেক দ্রুত গতিতে হয়েছে। এই গবেষণা প্রমাণ করে যে, হৃদরোগ ক্যান্সারের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে সক্ষম।

একই চিকিৎসায় দুই রোগের সমাধান?

যদি দুটি রোগের মধ্যে এত গভীর সংযোগ থাকে, তবে এমন কোনো চিকিৎসা কি সম্ভব যা একই সাথে দুটি রোগকেই প্রতিরোধ বা নিরাময় করতে পারে? উত্তরটি বেশ আশাব্যঞ্জক।

প্রথমত, জীবনযাত্রার পরিবর্তন। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন “Life’s Simple Seven” নামে একটি কর্মসূচির মাধ্যমে সাতটি বিষয় নিয়ন্ত্রণের কথা বলে: ব্যায়াম, কোলেস্টেরল, খাদ্যাভ্যাস, রক্তচাপ, ওজন, রক্তে শর্করা এবং ধূমপান বর্জন। দেখা গেছে, যারা এই সাতটি বিষয় ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের শুধু হৃদরোগই নয়, ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। প্রতিটি অনিয়ন্ত্রিত ঝুঁকির সাথে ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়তে থাকে। যারা কোনোটিই নিয়ন্ত্রণ করেন না, তাদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। সুতরাং, হৃদরোগের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করে আমরা ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও একটি বড় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি।

দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতের ঔষধ। বিজ্ঞানীরা এখন এমন ঔষধ তৈরির চেষ্টা করছেন যা এই দুই রোগের অভিন্ন কারণগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে। এর দুটি চমৎকার উদাহরণ ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে:

১. প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন কমানোর ঔষধ: আমাদের শরীর আঘাত পেলে বা সংক্রমণ হলে প্রদাহের মাধ্যমে তা সারিয়ে তোলে। কিন্তু কিছু বিরল জেনেটিক রোগে শিশুদের শরীরে প্রদাহ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাদের চিকিৎসার জন্য বিজ্ঞানীরা এমন একটি ঔষধ তৈরি করেছেন যা প্রদাহ সৃষ্টিকারী একটি নির্দিষ্ট অণুকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। পরবর্তীতে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন যে, এই একই প্রদাহ হৃদরোগের পেছনেও ভূমিকা রাখে। তারা হার্ট অ্যাটাক হওয়া রোগীদের উপর এই ঔষধ প্রয়োগ করে দেখেন, এটি পুনরায় হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে সক্ষম। কিন্তু সবচেয়ে বড় চমক ছিল অন্যখানে। দেখা গেল, যারা এই ঔষধটি গ্রহণ করেছেন, তাদের ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার হার এবং ক্যান্সারে মৃত্যুর হারও নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। যে ঔষধটি একটি প্রদাহজনিত রোগের জন্য তৈরি হয়েছিল, সেটি এখন ক্যান্সাররোধী ঔষধ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

২. দেহের প্রতিরোধক কোষকে শক্তিশালী করা: আমাদের শরীরে ম্যাক্রোফেজ নামক এক ধরনের কোষ আছে, যার আক্ষরিক অর্থ “বড় খাদক”। এর কাজ হলো শরীরে প্রবেশ করা ব্যাকটেরিয়া বা ক্ষতিকর কোষকে খেয়ে ফেলা। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা ভেবেছেন, যদি এই ম্যাক্রোফেজ কোষগুলোকে এমনভাবে শক্তিশালী করা যায় যাতে তারা ক্যান্সার কোষকেও খেয়ে ফেলে, তবে টিউমার বৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব। এই ধারণা থেকে তৈরি ঔষধ কিছু লিম্ফোমা রোগীর উপর প্রয়োগ করে অভাবনীয় ফল পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, তাদের শরীরের টিউমারগুলো যেন গলে মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একই সাথে, যখন তাদের রক্তনালীর সিটি স্ক্যান বিশ্লেষণ করা হলো, তখন দেখা গেল যে ধমনীতে জমে থাকা কোলেস্টেরলের স্তর বা প্ল্যাকও একইভাবে কমে আসছে। অর্থাৎ, যে ঔষধ ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করছে, সেটিই হৃদরোগের কারণকেও নির্মূল করছে।

শেষ কথা

প্রায় চার শতাব্দী আগে গ্যালিলিও শিখিয়েছিলেন যে, বিজ্ঞানে কোনো কিছুই চূড়ান্ত বা প্রশ্নাতীত নয়। আমাদের অবশ্যই প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে এবং বিভিন্ন শাখার মধ্যেকার অদৃশ্য দেয়াল ভেঙে ফেলতে হবে। ক্যান্সার এবং হৃদরোগকে আর দুটি পৃথক শত্রু হিসেবে দেখার দিন হয়তো শেষ হয়ে আসছে। যদি আমরা তাদের মধ্যকার যোগসূত্রকে কাজে লাগাতে পারি, তবে এমন এক নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বার উন্মোচিত হতে পারে যা একসাথে বিশ্বের এই দুই প্রধান ঘাতককে পরাজিত করতে সক্ষম হবে। হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন একটি ঔষধই আমাদের এই দুই ভয়াবহ রোগ থেকে মুক্তি দেবে।