টিস্যু থেকে ক্যান্সার ডায়াগনোসিস

ক্যান্সার একটি সাধারণ শব্দ যা শরীরের কোষগুলির অস্বাভাবিক বিভাজনকে বর্ণনা করে। যদিও কিছু ক্যান্সার অনেক বেশি পরিচিত, এর আসলে শত শত প্রকারভেদ রয়েছে, যেগুলির চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যাপকভাবে আলাদা। তাই একজন চিকিৎসক কিভাবে বিভিন্ন ক্যান্সারগুলির পার্থক্য করতে পারেন এবং সবচেয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রস্তাব করতে পারেন? এর উত্তর লুকিয়ে থাকে চিকিৎসকের কাছে নয়, বরং একজন বিশেষজ্ঞের হাতে, যাঁর কাজ হলো ক্যান্সারের সঠিক নির্ণয় করা – সেই বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন  হিস্টোপ্যাথোলজিস্ট।

টিস্যু সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ

ক্যান্সারের নির্ণয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয় একটি টিস্যু স্যাম্পল বা বায়োপসি সংগ্রহের মাধ্যমে। এই স্যাম্পলটি শরীর থেকে বের করে পরীক্ষার জন্য হিস্টোপ্যাথলজি ল্যাবে পাঠানো হয়। যখন টিস্যুটি ল্যাবে পৌঁছায়, তখন প্রথমে এটি একটি রাসায়নিক পদার্থ ফরমালিনে রাখা হয়, যা কোষগুলিকে সংরক্ষণ করে।

এরপর টিস্যুটি একটি টিস্যু প্রসেসর (Tissue Processor) নামক যন্ত্রে বিভিন্ন রাসায়নিকের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এই যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে টিস্যু থেকে পানি অপসারণ (Dehydration), পরিষ্কার (Clearing) এবং মোম (Wax) দিয়ে ভরাটকরণের (Infiltration) কাজ করে।

ব্লক তৈরি ও সেকশনিং

প্রক্রিয়াজাত টিস্যুটিকে এরপর একটি এমবেডিং সেন্টার (Embedding Center)-এ নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে সংশ্লিষ্ট টেকনোলজিস্ট টিস্যুটিকে গলিত প্যারাফিন মোমের মধ্যে একটি ছোট ছাঁচে স্থাপন করেন। মোম ঠান্ডা হয়ে জমে গেলে একটি টিস্যু ব্লক তৈরি হয়।

এই ব্লকটিকে এরপর মাইক্রোটোম (Microtome) নামক একটি বিশেষ যন্ত্রে স্থাপন করা হয়। এই যন্ত্রের সাহায্যে অত্যন্ত ধারালো ব্লেড ব্যবহার করে টিস্যু ব্লকের ৪-৫ মাইক্রন পাতলা স্তর বা সেকশন কাটা হয়। এই সেকশনগুলো এতটাই পাতলা যে এগুলোর মধ্য দিয়ে আলোকরশ্মি সহজেই চলাচল করতে পারে, যা মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষার জন্য অপরিহার্য। কিছু ক্ষেত্রে, খুব দ্রুত রোগ নির্ণয়ের জন্য, বিশেষ করে অস্ত্রোপচার চলাকালীন, ক্রায়োস্ট্যাট (Cryostat) নামক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যা টিস্যুকে জমিয়ে পাতলা সেকশন তৈরি করে।

স্লাইডিং এবং স্টে‌ইনিং

কাটা সেকশনগুলোকে এরপর কাঁচের স্লাইডে স্থাপন করা হয় এবং অটোমেটেড স্টেইনার (Automated Stainer) যন্ত্রে পাঠানো হয়। এই যন্ত্রটি স্লাইডগুলোকে বিভিন্ন ধরনের রঙ বা স্টেইন দিয়ে রাঙিয়ে তোলে। সবচেয়ে সাধারণ স্টেইনিং পদ্ধতি হলো হেমোটক্সিলিন এবং ইওসিন (H&E) স্টেইন, যা কোষের নিউক্লিয়াসকে নীল এবং সাইটোপ্লাজমকে গোলাপী রঙে রাঙায়। এই রঙ কোষের বিভিন্ন অংশকে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান করে তোলে।

মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা ও চূড়ান্ত রিপোর্ট

রঙিন স্লাইডগুলো প্রস্তুত হয়ে গেলে প্যাথোলজিস্ট একটি শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ (Microscope)-এর নিচে সেগুলো পরীক্ষা করেন। তিনি কোষের আকার, আকৃতি, বিন্যাস এবং নিউক্লিয়াসের গঠন পর্যবেক্ষণ করে ক্যান্সার কোষ শনাক্ত করেন। ক্যান্সারের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি (মাইটোসিস) বা কোষের মৃত্যু (নেক্রোসিস)।

একজন হিস্টোপ্যাথোলজিস্টের জন্য প্রতিটি কোষকে খুঁটিয়ে দেখা অত্যন্ত কঠিন কাজ, যার জন্য বহু বছরের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কখনো কখনো রোগ নির্ণয় আরও জটিল হলে, একাধিক হিস্টোপ্যাথোলজিস্ট একসাথে মাল্টিহেড মাইক্রোস্কোপে বসে আলোচনা করেন, যাকে প্যানেল ডিসকাশন বলা হয়, যাতে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়।

সবশেষে, হিস্টোপ্যাথোলজিস্ট একটি চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করে তা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে পাঠান। চিকিৎসক এই ফলাফল রোগীর সাথে আলোচনা করেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ, যেমন সার্জারি, কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপির, সিদ্ধান্ত নেন।

এই পুরো প্রক্রিয়াটি একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা, যেখানে হিস্টোপ্যাথোলজিস্ট, টেকনোলজিস্ট এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা পর্দার আড়ালে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের কঠোর পরিশ্রম এবং দক্ষতার ফলেই রোগীরা সঠিক এবং সময়মত চিকিৎসা পায়। এই অদেখা নায়কদের অবদান সত্যিই অনস্বীকার্য।