ক্যান্সার এবং স্ট্রেসঃ অদৃশ্য শত্রু যখন দেহের ভেতরেই

ক্যান্সার—এই একটি শব্দই যেকোনো মানুষের জীবনকে মুহূর্তের মধ্যে ওলটপালট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই রোগ নির্ণয়ের পর শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি যে प्रचंड মানসিক ধকল শুরু হয়, তা প্রায়শই চিকিৎসার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কি শুধু মনের ওপরই প্রভাব ফেলে, নাকি ক্যান্সারের মতো ভয়ঙ্কর রোগের গতিপথকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, উত্তরটি হ্যাঁ। স্ট্রেস ক্যান্সারের চিকিৎসায় একটি অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করতে পারে।

স্ট্রেস কীভাবে কাজ করে এবং কেন তা ক্যান্সারের জন্য বিপজ্জনক?

আমাদের শরীর স্বল্পমেয়াদী স্ট্রেসের জন্য তৈরি। আদিম যুগে মানুষ যখন হিংস্র পশুর মুখোমুখি হতো, তখন শরীর “ফাইট-অর-ফ্লাইট” (fight-or-flight) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ্যাড্রেনালিন এবং কর্টিসলের মতো স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করত। এই হরমোনগুলো মানুষকে হয় লড়াই করার জন্য বা পালিয়ে যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত শক্তি জোগাত। বিপদ কেটে গেলে শরীর আবার স্বাভাবিক বা হোমিওস্ট্যাসিস অবস্থায় ফিরে আসত।

কিন্তু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। রোগ নির্ণয়ের পর থেকে শুরু হয় এক দীর্ঘমেয়াদী মানসিক সংগ্রাম—মৃত্যুভয়, চিকিৎসার কষ্ট, আর্থিক চিন্তা, শারীরিক পরিবর্তন এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। এই লাগাতার মানসিক চাপের ফলে শরীর ক্রমাগত স্ট্রেস হরমোন তৈরি করতে থাকে। আর এখানেই লুকিয়ে আছে মূল বিপদ। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয় এবং এমন এক পরিবেশ তৈরি করে, যা ক্যান্সারের কোষগুলোকে দ্রুত বাড়তে এবং ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। সোজা কথায়, যে মানসিক চাপকে আমরা রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলে মনে করি, তা আসলে রোগের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করতে পারে।

বিজ্ঞানের চোখে স্ট্রেস ও ক্যান্সারের যোগসূত্র

“সোশিওজেনোমিক্স” (Socio-genomics) নামে বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা প্রমাণ করেছে যে আমাদের মানসিক এবং সামাজিক পরিবেশ কীভাবে জিনের কার্যকলাপকে প্রভাবিত করতে পারে। এই ক্ষেত্রের পথিকৃৎ ইউসিএলএ-র গবেষক ডঃ স্টিভেন কোল ইঁদুরের ওপর এক যুগান্তকারী গবেষণা করেন।

গবেষণায় দেখা যায়, যে ইঁদুরগুলোকে একা বা অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে রেখে মানসিক চাপে রাখা হয়েছিল, তাদের শরীরে টিউমার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, যে ইঁদুরগুলোকে আদর ও যত্ন করা হয়েছিল, তাদের টিউমারের বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে ধীর ছিল।

মানুষের ক্ষেত্রেও এর প্রমাণ মিলেছে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যে নারীরা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এবং সামাজিক সমর্থনের অভাবে ভোগেন, তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ওহাইও স্টেটের আরেকটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মানসিক চাপে থাকা ব্যক্তিদের ক্ষত সারতে শান্ত মনের মানুষদের চেয়ে ৪০% বেশি সময় লাগে। এই সমস্ত গবেষণা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছায়—আমাদের মানসিক অবস্থা শরীরের ভেতরের আণবিক প্রক্রিয়াকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে।

মনের শক্তিঃ জিনকে নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি

যদি মানসিক চাপ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, তবে কি মনকে শান্ত রেখে এই প্রক্রিয়াকে উল্টে দেওয়া সম্ভব? উত্তরটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটালের বেনসন-হেনরি ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র আট সপ্তাহের মেডিটেশন বা ধ্যান অনুশীলনের মাধ্যমে মানবদেহের ১৫০০-র বেশি জিনের কার্যকলাপে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

এই গবেষণায়, যারা আগে কখনো ধ্যান করেননি, তাদের শেখানো হয়েছিল কীভাবে ধ্যান করতে হয়। আট সপ্তাহ পরে তাদের জিন পরীক্ষা করে দেখা যায়, প্রায় ৮০০টি স্বাস্থ্য সহায়ক জিন সক্রিয় (up-regulated) হয়েছে এবং ৬০০-র বেশি স্ট্রেস-সম্পর্কিত জিন নিষ্ক্রিয় (down-regulated) হয়ে গেছে। এর অর্থ হলো, আমরা ধ্যানের মতো সহজ কৌশলের মাধ্যমে সচেতনভাবে আমাদের শরীরকে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারি।

ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন দিগন্তঃ মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব

বর্তমানে ক্যান্সার চিকিৎসাব্যবস্থা মূলত কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন এবং সার্জারির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রায়শই রোগীর মানসিক অবস্থাকে উপেক্ষা করা হয়। একবার ভাবুন তো, রোগীকে ক্যান্সারের খবর দেওয়ার পরেই যদি একজন বিশেষজ্ঞ বা ক্যান্সার থেকে সেরে ওঠা কোনো ব্যক্তি তার পাশে বসতেন? যদি তাকে চিকিৎসার জটিল প্রক্রিয়া, ভয়, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তা মোকাবেলার জন্য মানসিক সাহস জোগানো হতো?

এই ধরনের মানসিক সমর্থন যে শুধু রোগীর মনকে শান্ত করবে তা নয়, বরং তার শরীরের জিনগত স্তরেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যখন একজন রোগী মানসিকভাবে শান্ত ও ইতিবাচক থাকেন, তখন তার শরীর চিকিৎসার প্রতি ভালোভাবে সাড়া দেয় এবং আরোগ্যের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথাগত চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর মানসিক চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, কাউন্সেলিং এবং সাপোর্টিভ কেয়ার অত্যন্ত জরুরি। কারণ শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

শেষ কথা

ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও। দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস এই যুদ্ধে আমাদের অদৃশ্য শত্রু হিসেবে কাজ করে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে এবং চিকিৎসাকে কঠিন করে তোলে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির পাশাপাশি, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট বা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণকে চিকিৎসার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। ধ্যান, কাউন্সেলিং এবং সামাজিক সমর্থনের মতো বিষয়গুলো শুধু রোগীর জীবনযাত্রার মানই উন্নত করবে না, বরং ক্যান্সারের মতো মারণ রোগকে পরাজিত করার পথে এক নতুন এবং শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।