বিশ্বব্যাপী পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সারগুলোর মধ্যে প্রোস্টেট ক্যান্সার একটি। বাংলাদেশেও এর ঝুঁকি বাড়ছে। এই রোগটি প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ থাকে, কিন্তু একবার তা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে ওঠে। তাই, খাদ্যাভ্যাসের মতো যেসব বিষয় এই ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে বা কমাতে পারে, তা চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরি।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় ডিম খাওয়ার সঙ্গে প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকির একটি সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করতে পারে ডিমে থাকা ‘কোলিন’ নামের একটি পুষ্টি উপাদান।
গবেষণার ফলাফল কী বলছে?
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পুরুষ সপ্তাহে মাত্র আড়াইটি বা তার বেশি ডিম খান, তাদের মারাত্মক প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৮১% বেশি। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সবচেয়ে বেশি কোলিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করেন, তাদের প্রোস্টেট ক্যান্সারে মৃত্যুর ঝুঁকি ৭০% পর্যন্ত বাড়তে পারে।
এই গবেষণায় আরও একটি আশঙ্কার বিষয় হলো, যারা দিনে একটিরও কম ডিম খান, তাদের ক্ষেত্রেও প্রোস্টেট ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি যারা ডিম প্রায় খানই না তাদের তুলনায় দ্বিগুণ ছিল। পোল্ট্রির মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরও বেশি, প্রায় চারগুণ পর্যন্ত। গবেষকদের ধারণা, রান্না করা মুরগির মাংসে তৈরি হওয়া হেটেরোসাইক্লিক অ্যামাইনস (HCAs) নামক ক্যান্সার সৃষ্টিকারী যৌগ এর জন্য দায়ী হতে পারে।
কোলিন কীভাবে ঝুঁকি বাড়ায়?
কোলিন শরীরের জন্য একটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান, যা মস্তিষ্কের বিকাশ ও যকৃতের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ডিম, মাংস এবং দুধ কোলিনের প্রধান উৎস। তবে প্রোস্টেট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এই কোলিনই ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কথা বলছেন:
১. খাবার থেকে পাওয়া কোলিন হজমের সময় অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ট্রাইমিথাইলঅ্যামাইন (TMA) নামক যৌগে রূপান্তরিত হয়।
২. পরে এই TMA যকৃতে গিয়ে ট্রাইমিথাইলঅ্যামাইন এন-অক্সাইড (TMAO) নামক আরেকটি যৌগে পরিণত হয়।
৩. গবেষণায় দেখা গেছে, রক্তে TMAO-এর মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরে প্রদাহ বাড়ে, যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি এবং ছড়িয়ে পড়াকে উৎসাহিত করে।
একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের সিদ্ধ ডিম খাওয়ানোর পর দেখা গেছে, তাদের রক্তে ক্ষতিকর TMAO-এর মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়, যা রেড মিট বা লাল মাংস খাওয়ার পরেও দেখা যায়। শুধু তাই নয়, রক্তে TMAO-এর উচ্চ মাত্রা হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং মৃত্যুর ঝুঁকির সাথেও সম্পর্কিত।
ডিম শিল্প এবং কোলিনের প্রচার
মজার বিষয় হলো, ডিম শিল্প তাদের পণ্যের পুষ্টিগুণ প্রচারের সময় কোলিনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে তুলে ধরে। তবে তথ্য অধিকার আইনে প্রাপ্ত কিছু নথি থেকে জানা যায়, এই শিল্পের কর্তাব্যক্তিরা কোলিনের সাথে ক্যান্সারের ঝুঁকির বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। একটি ফাঁস হওয়া ইমেইলে দেখা যায়, ডিম শিল্পের একজন নির্বাহী স্বীকার করেছেন যে কোলিন ক্যান্সারের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু তারা এর প্রচার চালিয়ে যেতে আগ্রহী।
তাহলে কি ডিম খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে?
ডিম একটি সহজলভ্য এবং পুষ্টিকর খাবার। তবে প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে পরিমিত পরিমাণে ডিম খাওয়াই শ্রেয়। বিশেষজ্ঞরা সপ্তাহে ২টির বেশি ডিম (বিশেষত কুসুমসহ) না খাওয়ার পরামর্শ দেন, কারণ ডিমের সাদা অংশের চেয়ে কুসুমেই কোলিন বেশি থাকে।
কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে, খাদ্যাভ্যাসে কোলিনের মাত্রা কমালে প্রোস্টেট ক্যান্সারের বৃদ্ধি ধীর হতে পারে। তবে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
সবশেষে, যেকোনো খাবারই পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়াতে সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অত্যন্ত জরুরি। আপনার যদি এই বিষয়ে কোনো উদ্বেগ থাকে, তবে একজন চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করা সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হবে।