ক্যান্সার এক জটিল ও রহস্যময় প্রক্রিয়া যা বিজ্ঞানীদের কাছে আজও এক বিরাট বিস্ময়। এই ভয়ঙ্কর রোগটিকে বোঝার এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই করার নিরন্তর প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত জীববৈজ্ঞানিক বৈপরীত্য বা প্যারাডক্সের সম্মুখীন হয়েছেন, যা আজও অমীমাংসিত: বিশাল আকারের প্রাণীরা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে এক প্রকার স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখায়, যা সাধারণ যুক্তির সম্পূর্ণ বিপরীত। এই প্রবন্ধটি সেই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করে ক্যান্সার, পেটোর প্যারাডক্স এবং এর পেছনের সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তুলে ধরবে।
ক্যান্সার: কোষের বিশ্বাসঘাতকতা
আমাদের শরীর কোটি কোটি কোষ দ্বারা গঠিত, যা প্রোটিন নির্মিত অতিক্ষুদ্র রোবটের মতো কাজ করে। এই কোষগুলো রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে কাঠামো তৈরি করে, শক্তি উৎপাদন করে এবং নিজেদের প্রায় নিখুঁত অনুলিপি তৈরি করে। এই জটিল প্রক্রিয়াগুলো যখন নির্ভুলভাবে কাজ করে, তখন আমাদের শরীর সুস্থ থাকে। কিন্তু বিলিয়ন বিলিয়ন কোষের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
কোষের মধ্যে থাকা অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা ব্যবস্থা, যেমন ‘কিল সুইচ’, ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়ে শরীরকে সুরক্ষিত রাখে। কিন্তু এই সুরক্ষা ব্যবস্থাও কখনও কখনও ব্যর্থ হতে পারে। যখন এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন একটি কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজিত হতে শুরু করে এবং ক্যান্সারের জন্ম দেয়। যদিও আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বেশিরভাগ বিদ্রোহী কোষকে ধ্বংস করে ফেলে, কিছু কোষ ফাঁকি দিয়ে টিউমারে পরিণত হয়।
পেটোর প্যারাডক্স: আকারের সঙ্গে অদ্ভুত বৈপরীত্য
সাধারণ যুক্তি বলে, একটি প্রাণীর শরীরে যত বেশি কোষ থাকবে এবং তার আয়ু যত দীর্ঘ হবে, ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও তত বেশি হবে। কারণ কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ-তে ভুল বা মিউটেশন ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ইঁদুরের তুলনায় মানুষের আয়ু প্রায় ৫০ গুণ বেশি এবং কোষের সংখ্যা প্রায় ১,০০০ গুণ বেশি, অথচ উভয় প্রজাতিতে ক্যান্সারের হার প্রায় সমান। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, নীল তিমির মতো বিশাল প্রাণীর দেহে মানুষের চেয়ে প্রায় ৩,০০০ গুণ বেশি কোষ থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে ক্যান্সারের ঘটনা প্রায় নেই বললেই চলে।
১৯৭০-এর দশকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিশেষজ্ঞ রিচার্ড পেটো এই অসামঞ্জস্যটি প্রথম তুলে ধরেন। তাঁর নামানুসারেই এই ধাঁধাটি “পেটোর প্যারাডক্স” নামে পরিচিতি লাভ করে। এই প্যারাডক্সটি নির্দেশ করে যে, বড় আকারের প্রাণীদের মধ্যে অবশ্যই এমন কোনো শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে যা তাদের ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে।
সমাধানের সন্ধানে: বিবর্তনীয় প্রতিরক্ষা
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পেটোর প্যারাডক্সের একটি সম্ভাব্য সমাধান হলো বিবর্তন। প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর আগে যখন বহুকোষী প্রাণীর উদ্ভব হয়, তখন প্রাণীরা আকারে বড় হতে শুরু করে। এর ফলে তাদের কোষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। যেসব প্রাণী উন্নত ক্যান্সার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছিল, তারাই কেবল টিকে থাকতে পেরেছে।
এই প্রতিরক্ষার মূলে রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট জিন। কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোকে প্রোটো-অনকোজিন বলা হয়। এগুলিতে মিউটেশন ঘটলে কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে। এর বিপরীতে, টিউমার সাপ্রেসর জিন নামক এক ধরনের জিন রয়েছে, যা এই ক্ষতিকর মিউটেশন প্রতিরোধ করে বা ক্ষতিগ্রস্ত কোষকে ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, হাতির মতো বড় প্রাণীদের জিনোমে ‘পি৫৩’ (TP53) নামক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টিউমার সাপ্রেসর জিনের একাধিক কপি রয়েছে। মানুষের শরীরে যেখানে এই জিনের মাত্র একটি কপি থাকে, সেখানে হাতির শরীরে এর ২০টি কপি পাওয়া যায়। এর ফলে হাতির কোষের ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হতে অনেক বেশি সংখ্যক মিউটেশনের প্রয়োজন হয়, যা তাদের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে এক দারুণ সুরক্ষা প্রদান করে। একইভাবে, কচ্ছপের মতো দীর্ঘজীবী প্রাণীদের মধ্যেও শক্তিশালী টিউমার দমনকারী ব্যবস্থা এবং ডিএনএ মেরামতের উন্নত ক্ষমতা লক্ষ্য করা গেছে।
দ্বিতীয় সম্ভাবনা: হাইপারটিউমার
পেটোর প্যারাডক্সের আরেকটি চমকপ্রদ ব্যাখ্যা হলো “হাইপারটিউমার”-এর ধারণা। ক্যান্সার কোষগুলো সাধারণত স্বার্থপর হয় এবং শরীরের সম্পদ শোষণ করে নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধি করে। এই প্রক্রিয়ায় তারা টিউমার গঠন করে। কিন্তু ক্যান্সার কোষগুলো নিজেরাও জেনেটিক্যালি অস্থিতিশীল, যার ফলে তাদের মধ্যেও ক্রমাগত মিউটেশন ঘটতে থাকে।
সম্ভাবনা রয়েছে যে, মূল টিউমারের মধ্যে থাকা কিছু ক্যান্সার কোষ নতুন করে মিউটেশনের শিকার হয়ে আরও বেশি স্বার্থপর হয়ে ওঠে। তখন তারা মূল টিউমারকেই প্রতিযোগী হিসেবে দেখে এবং তার সম্পদ ও রক্ত সরবরাহ কেটে দেওয়ার চেষ্টা করে। এর ফলে একটি টিউমারের ভেতরেই আরেকটি টিউমার বা ‘হাইপারটিউমার’ তৈরি হতে পারে, যা মূল ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। অর্থাৎ, ক্যান্সার নিজেই ক্যান্সারকে মেরে ফেলে।
বড় আকারের প্রাণীদের শরীরে হয়তো প্রতিনিয়ত এমন অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্যান্সার তৈরি হয়, কিন্তু হাইপারটিউমারের কারণে সেগুলো বড় আকার ধারণ করার আগেই ধ্বংস হয়ে যায়। একটি ছোট ইঁদুরের জন্য ২ গ্রামের একটি টিউমার তার শরীরের ওজনের ১০% হলেও, একজন মানুষের জন্য তা নগণ্য (০.০০২%)। তাই, একটি নীল তিমি হয়তো অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্যান্সার নিয়ে বেঁচে থাকে, যা তার বিশাল শরীরে কোনো প্রভাবই ফেলে না।
ভবিষ্যতের পথে
পেটোর প্যারাডক্সের সমাধান এখনো পুরোপুরি মেলেনি। কোষের স্থাপত্য, বিপাকীয় হার এবং অন্যান্য বিষয়গুলোও হয়তো এর পেছনে ভূমিকা রাখে। তবে বিজ্ঞানীরা এই রহস্য সমাধানে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। বড় প্রাণীরা কীভাবে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগকে প্রতিহত করে, তা বুঝতে পারলে হয়তো মানুষের জন্যও নতুন এবং যুগান্তকারী চিকিৎসার পথ উন্মোচিত হবে। এই জীববৈজ্ঞানিক ধাঁধার সমাধান মানবজাতিকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক নতুন দিশা দেখাতে পারে।