চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়ে গেলেও ক্যান্সার আজও বিশ্বজুড়ে এক বড় চ্যালেঞ্জ। এটি এমন একটি রোগ যা শরীরের যেকোনো অংশে হতে পারে এবং এর শতাধিক ধরন রয়েছে। তাই নির্দিষ্ট কোনো ‘একটি ক্যান্সার’ রোগ নেই। তবে সব ধরনের ক্যান্সারের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, এতে শরীরের কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে শুরু করে এবং প্রায়শই আশপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এই অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের ফলেই টিউমার তৈরি হয়, যা মারাত্মক রূপ নিতে পারে। বিশ্বজুড়ে পুরুষদের মধ্যে ফুসফুস, প্রস্টেট এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সার সবচেয়ে সাধারণ, অন্যদিকে নারীদের মধ্যে স্তন, ফুসফুস এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
ক্যান্সার কোষ কেন আলাদা?
আমাদের শরীর ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে তৈরি, যেগুলো একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বৃদ্ধি পায়, বিভাজিত হয় এবং প্রয়োজন ফুরালে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মারা যায়, যাকে অ্যাপোপটোসিস বা কোষীয় মৃত্যু বলা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি আমাদের জিনের কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু ক্যান্সার কোষে এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটি নষ্ট হয়ে যায়।
ক্যান্সার কোষগুলো সাধারণ কোষের মতো মৃত্যুর সংকেত পায় না। ফলে তারা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজিত হতে থাকে এবং কোষের স্তূপ তৈরি করে, যা টিউমার নামে পরিচিত। কিছু ক্যান্সার, যেমন লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সার, টিউমার তৈরি না করে রক্ত বা অস্থিমজ্জায় ছড়িয়ে পড়ে। ক্যান্সার কোষগুলো তাদের চারপাশের সাধারণ কোষকে আক্রমণ করতে পারে এবং রক্ত বা লসিকা ব্যবস্থার মাধ্যমে শরীরের দূরবর্তী স্থানেও পৌঁছে যেতে পারে, যাকে মেটাস্ট্যাসিস বলা হয়। এই ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতাই ক্যান্সারকে এতটা বিপজ্জনক করে তুলেছে।
ক্যান্সারের মূল কারণগুলো কী কী?
ক্যান্সার মূলত কোষের ডিএনএ-তে জেনেটিক পরিবর্তনের কারণে হয়। এই পরিবর্তন বা মিউটেশন কোষের বৃদ্ধি ও বিভাজন নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিছু মিউটেশন আমরা জন্মসূত্রে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেতে পারি, তবে বেশিরভাগই অর্জিত হয়, অর্থাৎ জীবনে চলার পথে বিভিন্ন কারণে ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা ঘটে।
এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. জীবনযাত্রা: ধূমপান এবং তামাকের ব্যবহার ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ, যা শুধু ফুসফুস নয়, আরও অনেক ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, প্রক্রিয়াজাত মাংস, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাবও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
২. পরিবেশগত কারণ: সূর্যের ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি, এক্স-রে এবং অন্যান্য তেজস্ক্রিয়তা ডিএনএ-কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অ্যাসবেস্টস, বেনজিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক কার্সিনোজেন বা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থের সংস্পর্শেও এই ঝুঁকি বাড়ে।
৩. সংক্রমণ: কিছু ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের মাধ্যমে ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। যেমন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস বা এইচপিভি জরায়ুমুখের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. বয়স বৃদ্ধি: বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের শরীরে কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ-তে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। শরীরের মেরামত ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ায় এই ভুলগুলো জমে গিয়ে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
চিকিৎসায় আধুনিক অগ্রগতি
গত দশকে ক্যান্সার চিকিৎসায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। পুরনো পদ্ধতি যেমন সার্জারি, কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন থেরাপির পাশাপাশি এখন আরও উন্নত ও কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি সহজলভ্য হয়েছে।
- টার্গেটেড থেরাপি: এই ওষুধগুলো বিশেষভাবে ক্যান্সার কোষের দুর্বলতাকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়। এটি কেমোথেরাপির মতো সাধারণ কোষের ক্ষতি না করে শুধু ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে, ফলে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম।
- ইমিউনোথেরাপি: এই চিকিৎসাপদ্ধতি আমাদের শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শক্তিশালী করে তোলে। এটি অনেক ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসায় যুগান্তকারী সাফল্য এনেছে।
- পার্সোনালাইজড মেডিসিন: এখন রোগীর টিউমারের জেনেটিক গঠন বিশ্লেষণ করে তার জন্য সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে নির্দিষ্ট মিউটেশনের ওপর ভিত্তি করে সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করা যায়, যা চিকিৎসার সাফল্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
- এমআরএনএ ভ্যাকসিন: কোভিড-১৯ টিকার মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়া এমআরএনএ প্রযুক্তি এখন ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন আশা জাগাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে থেরাপিউটিক ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণা দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।
প্রতিরোধ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক জীবনযাত্রা এবং সময়মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। ধূমপান বর্জন, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলার মতো সাধারণ অভ্যাসগুলো ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। এইচপিভি এবং হেপাটাইটিস বি-এর মতো টিকাগুলো ভাইরাসজনিত ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।
আজ ক্যান্সারকে আর অবধারিত মৃত্যুদণ্ড হিসেবে দেখা হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই এটি একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য দীর্ঘস্থায়ী রোগে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা ক্যান্সারকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছি এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আরও শক্তিশালী অস্ত্র তৈরি করছি। ভবিষ্যতের লক্ষ্য হলো প্রতিটি রোগীর জন্য একটি স্বতন্ত্র ও কার্যকর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, যা এই ভয়াবহ রোগকে একদিন পুরোপুরি পরাজিত করতে সাহায্য করবে।