ক্যান্সার মেটাস্ট্যাসিসঃ এক নীরব ঘাতকের পদযাত্রা

 

আমাদের শরীর কোটি কোটি কোষের এক সুশৃঙ্খল রাজ্য, যেখানে প্রতিটি কোষ তার নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু এই রাজ্যের কোনো এক কোণে যদি বিদ্রোহ দেখা দেয়? যদি কিছু কোষ নিয়ম ভেঙে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে শুরু করে, তখন তাকে আমরা ক্যান্সার বলি। তবে ক্যান্সারের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপটি হলো তার ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘মেটাস্ট্যাসিস’ নামে পরিচিত। এটি এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে ক্যান্সার কোষ তার উৎপত্তিস্থল থেকে বেরিয়ে শরীরের দূরবর্তী কোনো স্থানে নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুর সিংহভাগই এই মেটাস্ট্যাসিসের কারণে ঘটে থাকে।

বিদ্রোহের সূচনা ও সীমানা লঙ্ঘন

ক্যান্সারের গল্প শুরু হয় একটি প্রাথমিক টিউমার বা কোষের পিণ্ড থেকে। শরীরের কোনো একটি অঙ্গে যখন কোষের বিভাজন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন এই টিউমারের জন্ম হয়। সাধারণ বা বিনাইন টিউমারগুলো সাধারণত তাদের উৎপত্তিস্থলেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে না। কিন্তু ম্যালিগন্যান্ট বা ক্ষতিকর টিউমারের কোষগুলো হয় উচ্চাভিলাষী। তারা কেবল সংখ্যাবৃদ্ধি করেই সন্তুষ্ট থাকে না, বরং আশেপাশের সুস্থ টিস্যু বা কলার সীমানা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘লোকাল ইনভেশন’ বা স্থানীয় আক্রমণ। ক্যান্সার কোষগুলো এক বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক আবরণী ভেঙে ফেলে এবং চলাচলের ক্ষমতা অর্জন করে, যেন তারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অজানার পথে যাত্রা: রক্ত ও লসিকা নালীর মহাসড়ক

সীমানা অতিক্রম করার পর ক্যান্সার কোষগুলোর সামনে খুলে যায় দুটি প্রধান পথ বা মহাসড়ক—রক্তনালী এবং লসিকা নালী। এই দুটি পথই সারা শরীরে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। ধূর্ত ক্যান্সার কোষগুলো এই নালীগুলোর প্রাচীর ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে, যাকে বলা হয় ‘ইন্ট্রাভাসেশন’। একবার রক্ত বা লসিকার স্রোতে মিশে যেতে পারলেই তাদের সামনে খুলে যায় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ার অবারিত সুযোগ। লক্ষ লক্ষ বিদ্রোহী কোষ এই স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয় এক অনিশ্চিত যাত্রাপথে।

স্রোতের প্রতিকূলে লড়াই এবং নতুন আশ্রয়ের সন্ধান

রক্তস্রোতের এই যাত্রা মোটেও সহজ নয়। এখানে তাদের টিকে থাকার জন্য কঠিন লড়াই করতে হয়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রহরীরা (ইমিউন সেল) এই বহিরাগত কোষগুলোকে চিনে ফেলে এবং ধ্বংস করার চেষ্টা করে। এছাড়া, রক্তস্রোতের তীব্র চাপেও অনেক কোষ নষ্ট হয়ে যায়। টিকে থাকার জন্য ক্যান্সার কোষগুলো কখনও কখনও রক্তের প্লেটলেট বা অণুচক্রিকার সাথে মিলে একটি বর্ম তৈরি করে নিজেদের রক্ষা করে। যারা এই কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, তারাই মেটাস্ট্যাসিসের পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুত হয়।

এরপর আসে নতুন একটি ঠিকানা খুঁজে নেওয়ার পালা। শরীরের যেকোনো স্থানেই ক্যান্সার কোষগুলো ঘাঁটি গাড়তে পারে না। ঠিক যেমন যেকোনো মাটিতে সব বীজ অঙ্কুরিত হয় না, তেমনই ক্যান্সার কোষগুলোর বেড়ে ওঠার জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ বা ‘মাটি’ প্রয়োজন হয়। ফুসফুস, যকৃত, মস্তিষ্ক এবং হাড় হলো কিছু সাধারণ স্থান যেখানে ক্যান্সার কোষগুলো নতুন করে বসতি স্থাপন করতে ভালোবাসে। উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাওয়ার পর, ক্যান্সার কোষ রক্ত বা লসিকা নালীর প্রাচীর আবার ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং নতুন টিস্যুতে প্রবেশ করে। এই প্রক্রিয়াটির নাম ‘এক্সট্রাভাসেশন’।

নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা এবং তার বিধ্বংসী পরিণতি

নতুন জায়গায় থিতু হওয়ার পর একটি বা কয়েকটি কোষ আবার বিভাজিত হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে একটি নতুন টিউমার গড়ে তোলে, যা ‘সেকেন্ডারি টিউমার’ বা মেটাস্ট্যাটিক টিউমার নামে পরিচিত। এই নতুন টিউমারটি নিজের পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য নতুন রক্তনালী তৈরি করতেও সক্ষম, যা তার দ্রুত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

এর পরিণতি হয় মারাত্মক। ফুসফুসে মেটাস্ট্যাসিস হলে শ্বাসকষ্ট, যকৃতে হলে জন্ডিস এবং হাড়ে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র ব্যথা বা হাড় ভাঙার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। মস্তিষ্কে এটি ছড়িয়ে গেলে মাথাব্যথা বা স্নায়ুবিক সমস্যা হতে পারে। মেটাস্ট্যাসিস ক্যান্সারের চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত জটিল করে তোলে, কারণ তখন কেবল একটি স্থানের বদলে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়।

ক্যান্সার মেটাস্ট্যাসিস একটি অত্যন্ত জটিল এবং বহু ধাপের প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানীরা আজও এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি রহস্য উন্মোচনের জন্য নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। মেটাস্ট্যাসিসের এই নীরব পদযাত্রাকে থামানোর উপায় বের করতে পারলেই ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সবচেয়ে বড় জয় আসবে। আর সেই লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে গবেষকরা কেমোথেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপির মতো নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নতি সাধনে কাজ করে চলেছেন।