আমরা যখন দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাই, আমাদের মূল চিন্তা থাকে দাঁতের ক্ষয় বা মাড়ির সমস্যা নিয়ে। কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনার ডাক্তার দাঁত পরীক্ষার পাশাপাশি আরও একটি গুরুতর রোগের লক্ষণ খুঁজছেন? সেটি হলো মুখের ক্যান্সার বা ওরাল ক্যান্সার। এটি এমন একটি রোগ যা ঠোঁট, জিহ্বা, গাল, মুখের তালু, গলাসহ মুখের যেকোনো অংশে হতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা না গেলে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে এবং জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
মুখগহ্বরের ক্যান্সার কী এবং ঝুঁকি কাদের বেশি?
মুখগহ্বরের ক্যান্সার হলো মুখের কোষের অস্বাভাবিক এবং অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি। এই ক্যান্সার সাধারণত মুখের ভেতরের স্কোয়ামাস সেল বা পাতলা, চ্যাপ্টা কোষ থেকে শুরু হয়। বিশ্বজুড়ে এটি অন্যতম প্রচলিত একটি ক্যান্সার, বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে এর ঝুঁকি নারীদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ৫০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের মধ্যে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। পুরুষদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রকারভেদে এর অবস্থান ষষ্ঠ।
এই রোগের ঝুঁকির পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, তবে সবচেয়ে বড় এবং মারাত্মক কারণটি হলো তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার। গবেষণায় দেখা গেছে, মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীই কোনো না কোনোভাবে তামাক সেবন করেন, তা সে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, পানমশলা বা গুল হোক না কেন। তামাকের মধ্যে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক মুখের ভেতরের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সেগুলোর ডিএনএ-তে পরিবর্তন ঘটায়, যা ক্যান্সারের জন্ম দেয়। তামাকের পাশাপাশি অতিরিক্ত মদ্যপানও মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) সংক্রমণ, পরিবারে ক্যান্সারের ইতিহাস, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ঠোঁটের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সূর্যের আলোয় থাকা।
লক্ষণগুলো চিনে নিন: অবহেলার সুযোগ নেই
মুখের ক্যান্সারের সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে এর লক্ষণগুলো খুব সাধারণ হওয়ায় অনেকেই অবহেলা করেন। কিন্তু এই লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকলে প্রাথমিক অবস্থাতেই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ নিচে দেওয়া হলো:
- দীর্ঘস্থায়ী ঘা: মুখের ভেতরে বা ঠোঁটে এমন কোনো ঘা যা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরেও শুকায় না।
- সাদা বা লাল ছোপ: মুখের ভেতরে সাদা বা লাল রঙের দাগ বা ছোপ দেখা দেওয়া, যা ঘষলেও ওঠে না।
- ফোলা বা পিন্ড: মুখ, গলা বা ঘাড়ের কোনো অংশ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠা বা কোনো পিন্ডের মতো অনুভব করা।
- অস্বাভাবিক রক্তপাত: মুখের ভেতর কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই রক্তপাত হওয়া।
- অসাড়তা বা ব্যথা: মুখ, মুখমণ্ডল বা ঘাড়ে অবশ হয়ে যাওয়া, ব্যথা বা কোনো কারণ ছাড়াই চিনচিন করা।
- চিবানো বা গিলতে অসুবিধা: খাবার চিবানো, গেলা বা কথা বলার সময় কষ্ট বা ব্যথা অনুভব করা।
- গলার স্বর পরিবর্তন: হঠাৎ করে গলার স্বর ভারী হয়ে যাওয়া বা কর্কশ শোনানো।
- দাঁত নড়ে যাওয়া: কোনো কারণ ছাড়াই দাঁত আলগা হয়ে যাওয়া।
এই লক্ষণগুলোর কোনোটি দেখা দিলে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত একজন দন্ত চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
নিজেই করুন মুখের পরীক্ষা: প্রতিরোধে প্রথম ধাপ
আপনার দাঁতের ডাক্তার যেমন আপনার মুখ পরীক্ষা করেন, তেমনি আপনিও প্রতি মাসে একবার আয়না ও আলোর সাহায্যে নিজের মুখ পরীক্ষা করতে পারেন। এই সহজ অভ্যাসটি আপনাকে যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দ্রুত শনাক্ত করতে সাহায্য করবে।
পরীক্ষার ধাপগুলো:
১. একটি ভালোভাবে আলোকিত স্থানে আয়নার সামনে দাঁড়ান।
২. আপনার ঠোঁটের ভেতর ও বাইরের অংশ ভালোভাবে দেখুন।
৩. গালের ভেতরের অংশ, মাড়ি এবং তালু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করুন।
৪. জিহ্বা বের করে এর ওপর, নিচ এবং দুই পাশ ভালোভাবে দেখুন।
৫. কোনো ধরনের পিন্ড, ফোলা, ঘা বা রঙের পরিবর্তন চোখে পড়ে কিনা, তা লক্ষ করুন।
এই পরীক্ষায় কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়লে বা কোনো সন্দেহ হলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা: দ্রুত শনাক্তকরণই সাফল্যের চাবিকাঠি
যদি চিকিৎসকের কোনো স্থান সন্দেহজনক মনে হয়, তবে তিনি বায়োপসি করার পরামর্শ দিতে পারেন। বায়োপসিতে আক্রান্ত স্থানের কোষ পরীক্ষা করে ক্যান্সার আছে কিনা তা নিশ্চিত করা হয়।
মুখের ক্যান্সার ভয়ের কারণ হলেও, প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, স্টেজ-১ বা স্টেজ-২ এ রোগ শনাক্ত হলে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ রোগীই চিকিৎসার পর দীর্ঘ সময় সুস্থ জীবনযাপন করেন। চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে ক্যান্সারের ধরন, অবস্থান এবং পর্যায়ের ওপর। সাধারণত সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি এবং কেমোথেরাপির মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা হয়।
প্রতিরোধের পথে চলুন
সচেতনতা এবং জীবনযাত্রায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন মুখের ক্যান্সারকে অনেকাংশে প্রতিরোধ করতে পারে।
- তামাক ও মদ বর্জন করুন: তামাকজাত দ্রব্য এবং অ্যালকোহল মুখের ক্যান্সারের প্রধান কারণ, তাই এগুলো সম্পূর্ণরূপে পরিহার করুন।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: প্রচুর পরিমাণে ফল ও শাকসবজি খান। এগুলোতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
- নিয়মিত মুখ পরীক্ষা: প্রতি মাসে নিজে নিজের মুখ পরীক্ষা করুন এবং বছরে অন্তত দুবার দন্ত চিকিৎসকের কাছে যান।
- সূর্যের আলো থেকে সুরক্ষা: ঠোঁটকে অতিরিক্ত সূর্যের আলো থেকে বাঁচাতে সানস্ক্রিনযুক্ত লিপবাম ব্যবহার করুন।
মনে রাখবেন, মুখগহ্বরের ক্যান্সার একটি নীরব ঘাতক হতে পারে, কিন্তু আপনার সচেতনতাই এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। মুখের যেকোনো পরিবর্তনে সতর্ক হন, নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং একটি সুস্থ জীবনধারা বেছে নিন। কারণ, প্রাথমিক শনাক্তকরণই পারে জীবন বাঁচাতে।