হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস বা এইচপিভি (HPV) একটি সাধারণ ভাইরাস যা মূলত শারী*রিক মেলা*মেশার মাধ্যমে ছড়ায়। অনেকেই এই ভাইরাসের নাম শুনেছেন জরায়ুমুখের ক্যান্সারের সঙ্গে সম্পর্কিত হিসেবে, কিন্তু অনেকেই জানেন না যে এই ভাইরাস মুখের ক্যান্সারেরও একটি অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশ্বজুড়ে মুখের ক্যান্সারের হার বৃদ্ধির পেছনে এইচপিভি-কে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এইচপিভি কীভাবে মুখের ক্যান্সার ঘটায়?
এইচপিভি-এর ১০০টিরও বেশি প্রকারভেদ রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। বিশেষত, এইচপিভি-১৬ নামক প্রকারটি মুখের ক্যান্সারের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। বিশেষ সময়ে,এই ভাইরাস মুখ এবং গলার পেছনের অংশে, অর্থাৎ টনসিল ও জিহ্বার গোড়ায় সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
শরীরে ভাইরাস প্রবেশের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজে থেকেই এটিকে ধ্বংস করে দেয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি কখনও জানতেই পারেন না যে তিনি সংক্রমিত হয়েছিলেন। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাসটি শরীরে দীর্ঘকাল ধরে সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। বছরের পর বছর, এমনকি দশকের পর দশক পরেও, এই ভাইরাস কোষের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে, যা ধীরে ধীরে ক্যান্সারে রূপ নেয়। এই ধরনের ক্যান্সারকে বলা হয় অরোফ্যারিনজিয়াল ক্যান্সার (Oropharyngeal Cancer)।
লক্ষণগুলো কী কী?
এইচপিভি-জনিত মুখের ক্যান্সারের লক্ষণগুলো প্রায়শই সাধারণ গলা ব্যথা বা অন্য ছোটখাটো সমস্যার মতো মনে হতে পারে, যা প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়কে কঠিন করে তোলে। কিছু সাধারণ লক্ষণের মধ্যে রয়েছে:
- দীর্ঘদিন ধরে গলা ব্যথা যা সারছে না।
- ঘাড় বা গলায় ফোলা বা মাংসপিণ্ড দেখা দেওয়া।
- কিছু গিলতে গেলে ব্যথা বা অসুবিধা অনুভব করা।
- কানে ক্রমাগত ব্যথা।
- কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন বা কর্কশ হয়ে যাওয়া।
- মুখের ভেতরে ঘা যা সহজে শুকায় না।
অনেক সময় ঘাড়ের লসিকা গ্রন্থি (lymph nodes) ফুলে যাওয়াটাই এই ক্যান্সারের প্রথম লক্ষণ হিসেবে ধরা পড়ে, যা রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে।
চিকিৎসা এবং নিরাময়ের সম্ভাবনা
সৌভাগ্যবশত, এইচপিভি-সম্পর্কিত মুখের ক্যান্সার চিকিৎসায় ভালোভাবে সাড়া দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই সফল চিকিৎসা সম্ভব। চিকিৎসার পদ্ধতি নির্ভর করে ক্যান্সারের পর্যায় এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর। সাধারণত, সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি এবং কেমোথেরাপি—এই তিনটি পদ্ধতির সমন্বয় করে চিকিৎসা করা হয়।
- সার্জারি: টিউমার এবং আক্রান্ত লসিকা গ্রন্থি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়।
- রেডিয়েশন থেরাপি: উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন রশ্মি ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়।
- কেমোথেরাপি: ওষুধের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকা ক্যান্সার কোষকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়
এইচপিভি-জনিত মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এইচপিভি ভ্যাকসিন বা টিকা গ্রহণ। এই টিকা এইচপিভি-এর সেই প্রকারগুলোর বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে যা ক্যান্সারের জন্য প্রধানত দায়ী। সাধারণত, ১১ থেকে ১২ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের এই টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ যুগল জীবন শুরুর আগে টিকা নিলে এর কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি হয়। তবে ২৬ বছর বয়স পর্যন্ত এই টিকা নেওয়া যেতে পারে।
এছাড়াও, নিরাপদ অভ্যাস এবং নিয়মিত দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়ে মুখ ও গলা পরীক্ষা করানো প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে। মুখের স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন থাকা এবং যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। মুখের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সচেতনতাই আমাদের প্রধান অস্ত্র।