রুপার বয়স এখন ৩৫। অফিসের ব্যস্ততা, সংসারের দায়িত্ব আর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা—সব মিলিয়ে নিজের জন্য সময় বের করাটা যেন অনেক কঠিন হয়ে উঠেছে। শরীরে মাঝে মাঝে ক্লান্তি আসে, কিন্তু তিনি মনে করেন এটা তো স্বাভাবিক। তবে একদিন এক সহকর্মী হঠাৎ বললেন—“নিজের স্বাস্থ্যটাও একটু খেয়াল করো। আমরা বাইরে থেকে সুস্থ দেখালেও ভেতরে কী চলছে, সেটা তো জানি না।” কথাটা রুপার মনে দাগ কাটল।
আসলে আজকের দিনে প্রায় সব নারীই একই পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। কাজের চাপ সামলাতে গিয়ে নিজের শরীরের দিকে খেয়াল করার সময়টাই থাকে না। অথচ সুস্থতা ছাড়া জীবনের অন্য কোনো দায়িত্বই পালন করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ক্যানসারের মতো রোগ তো চুপিচুপি শরীরে বাসা বাঁধে। তবে একটা ভালো খবর আছে—সময়মতো পরীক্ষা করালে ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে এবং পুরোপুরি সেরে ওঠাও সম্ভব হয়।
চলুন, রুপার মতো আমাদের সবার জন্যই জরুরি সেই পাঁচটি স্ক্রিনিং পরীক্ষার গল্প শোনা যাক—
১. প্যাপ টেস্ট: জরায়ুমুখের প্রহরী
অনেক নারী জানেনই না যে জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রথমদিকে কোনো লক্ষণ দেখায় না। হঠাৎ যখন বোঝা যায়, তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঠিক এই কারণেই প্যাপ টেস্ট জরুরি। ২১ বছর বয়স থেকে শুরু করে প্রতি তিন বছর অন্তর এই পরীক্ষা করানো উচিত। কয়েক মিনিটেই সম্পন্ন হয় এই পরীক্ষা, আর যদি প্রাথমিক সমস্যা ধরা পড়ে, চিকিৎসা শুরু করলেই সুস্থতা ফিরে পাওয়া যায়।
২. ম্যামোগ্রাম: স্তনের গোপন সংকেত
মিতা, রুপার স্কুলের বান্ধবী, ৪২ বছর বয়সে প্রথমবার ম্যামোগ্রাম করালেন। রিপোর্টে প্রাথমিক পর্যায়ের স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে। সৌভাগ্যবশত, চিকিৎসা শুরু করায় তিনি এখন একেবারেই সুস্থ। আসলেই ম্যামোগ্রাম এমন সূক্ষ্ম পরিবর্তন শনাক্ত করতে পারে যা বাইরে থেকে বা হাতের স্পর্শে ধরা পড়ে না। তাই ৪০ বছর পার হওয়ার পর নিয়মিত এই পরীক্ষা করানো দরকার।
৩. HPV DNA পরীক্ষা: ভাইরাসের শিকড় ধরা
জরায়ুমুখের ক্যানসারের পেছনে থাকে এক ধূর্ত ভাইরাস—HPV। একে দেখা যায় না, বোঝাও যায় না। কিন্তু এই ভাইরাসই হতে পারে বড় বিপদের কারণ। HPV DNA পরীক্ষা ভাইরাসটির উপস্থিতি ও ঝুঁকি শনাক্ত করে। বিশেষ করে ৩০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আগে থেকে জেনে গেলে চিকিৎসক দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারেন।
৪. BRCA-1/2 জিন স্ক্রিনিং: বংশগত ঝুঁকির গল্প
কিছু রোগ শরীরে আসে পরিবার থেকে পাওয়া জিনের মাধ্যমে। যেমন, স্তন বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ঝুঁকি যদি পরিবারে আগে থেকেই থাকে, তাহলে BRCA-1/2 জিন স্ক্রিনিং জানিয়ে দিতে পারে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। জানলে কী লাভ? অনেক। নিয়মিত পরীক্ষা, সঠিক চিকিৎসা পরিকল্পনা, এমনকি প্রয়োজনে প্রতিরোধমূলক সার্জারি—সব কিছুই আগে থেকে ঠিক করে নেওয়া যায়।
৫. হিস্টেরোস্কোপি: জরায়ুর ভেতরের চিত্র
অনেক নারী অকারণ রক্তপাত বা বারবার গর্ভপাতের সমস্যায় ভোগেন। কখনও কখনও এর পেছনে থাকতে পারে জরায়ুর ভেতরের সমস্যা—পলিপ, ফাইব্রয়েড বা ক্যানসার। হিস্টেরোস্কোপি হলো এমন এক পরীক্ষা, যেখানে সরাসরি জরায়ুর ভেতরটা দেখা যায়। শুধু দেখা নয়, প্রয়োজনে ছোটখাটো চিকিৎসাও সঙ্গে সঙ্গেই করা যায়।
শেষকথা
রুপাতেই ফিরে আসি। সহকর্মীর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি প্যাপ টেস্ট করালেন। রিপোর্ট একেবারে স্বাভাবিক এসেছে। কিন্তু এই একটি পরীক্ষাই তাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে—নিজের যত্ন নেওয়া কোনো বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজনীয় দায়িত্ব।
এই পাঁচটি পরীক্ষা আসলে শুধু মেডিকেল প্রসিডিওর নয়, এগুলো প্রতিটি নারীর জন্য সুরক্ষাকবচ। নিয়মিত পরীক্ষা মানে নিজেকে ভালোবাসা, পরিবারকে সুরক্ষিত রাখা, আর ভবিষ্যৎকে সুস্থ ও উজ্জ্বল করে তোলা।