ক্যান্সারের বিরুদ্ধে মানবজাতির সংগ্রাম বহু পুরনো। গত শতাব্দী ধরে এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি ও কারণ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্যান্সারের একটি নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে, যা রোগের মূল গভীরে প্রবেশ করে: ক্যান্সার কোষের শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া বা ‘মেটাবোলিজম’। এই মেটাবোলিজমকে লক্ষ্য করে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মেটাবোলিক থেরাপি’, যা ক্যান্সারের ‘জ্বালানি’ বন্ধ করার এক অভিনব কৌশল।
সাধারণত, আমাদের শরীরের কোষগুলো শক্তি উৎপাদনের জন্য অক্সিজেন ব্যবহার করে এবং এটি একটি অত্যন্ত দক্ষ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘অক্সিজেনিক রেসপিরেশন’। কিন্তু প্রায় ১০০ বছর আগে জার্মান বিজ্ঞানী অটো ওয়ারবার্গ লক্ষ্য করেন যে ক্যান্সার কোষগুলো অক্সিজেনের উপস্থিতি সত্ত্বেও, শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রধানত ‘গ্লাইকোলাইসিস’ নামক একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে, যা অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে ঘটে। এই ঘটনাকে ‘ওয়ারবার্গ প্রভাব’ বলা হয়। ক্যান্সার কোষগুলো দ্রুত বৃদ্ধি ও বিভাজনের জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়, এবং গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে কম দক্ষ হলেও, এটি দ্রুত শক্তি উৎপাদন করতে পারে এবং কোষ বিভাজনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে।
ক্যান্সার কোষের এই পরিবর্তিত মেটাবোলিজম কেবল গ্লাইকোলাইসিসে সীমাবদ্ধ নয়। তারা অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যেমন গ্লুটামিন, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং নিউক্লিওটাইডকেও নিজেদের বৃদ্ধিতে ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, গ্লুটামিনোলাইসিস নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষগুলো গ্লুটামিন থেকে শক্তি এবং অন্যান্য বিল্ডিং ব্লক তৈরি করে। একইভাবে, তারা অতিরিক্ত লিপিড (চর্বি) সংশ্লেষণ করে যা তাদের কোষ পর্দার অখণ্ডতা এবং সংকেত প্রবাহের জন্য অপরিহার্য। এই পরিবর্তিত মেটাবোলিক পথগুলো ক্যান্সার কোষকে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
ক্যান্সার কোষের এই স্বতন্ত্র মেটাবোলিজমকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন নতুন থেরাপি তৈরির চেষ্টা করছেন। এই ‘মেটাবোলিক থেরাপি’র মূল লক্ষ্য হলো ক্যান্সার কোষের শক্তির উৎস বা মেটাবোলিক পথগুলোকে ব্যাহত করা, যাতে তারা বৃদ্ধি ও বিভাজনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি না পায় এবং শেষ পর্যন্ত মারা যায়।
এই ক্ষেত্রে বেশ কিছু কৌশল নিয়ে কাজ চলছে। একটি পদ্ধতি হলো গ্লুকোজের ব্যবহার কমানো। যেহেতু ক্যান্সার কোষগুলো গ্লাইকোলাইসিসের মাধ্যমে প্রচুর গ্লুকোজ ব্যবহার করে, তাই এমন ঔষধ তৈরি হচ্ছে যা গ্লুকোজের গ্রহণ বা ব্যবহারকে বাধা দেয়। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত মেটফর্মিন নামক একটি ঔষধ, যা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং গ্লুকোজ উৎপাদন কমায়, সেটি কিছু ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল দিয়েছে এবং এর ওপর আরও গবেষণা চলছে। ২-ডিঅক্সিগ্লুকোজ (2-DG) নামক একটি যৌগও এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা গ্লুকোজের মতো দেখতে হলেও, এটি ক্যান্সার কোষের গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়াকে বন্ধ করে দেয়।
অন্যান্য মেটাবোলিক পথের উপর লক্ষ্য রেখেও থেরাপি তৈরি হচ্ছে। গ্লুটামিনোলাইসিসকে বাধা দেওয়ার জন্য কিছু ঔষধ নিয়ে গবেষণা চলছে। একইভাবে, ক্যান্সার কোষের লিপিড সংশ্লেষণ বা ফ্যাটি অ্যাসিড ব্যবহারকে বাধা দিতে পারে এমন থেরাপিও তৈরি হচ্ছে। এই থেরাপিগুলোর উদ্দেশ্য হলো ক্যান্সার কোষকে তার নিজস্ব পুষ্টির যোগান থেকে বঞ্চিত করা।
মেটাবোলিক থেরাপির একটি আকর্ষণীয় দিক হলো ‘ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা’। প্রতিটি টিউমারের নিজস্ব একটি মেটাবোলিক প্রোফাইল থাকতে পারে, যা তার জিনগত মেকআপ এবং পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানীরা এখন এমন কৌশল তৈরি করছেন যা প্রতিটি রোগীর টিউমারের মেটাবোলিক প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে কার্যকর মেটাবোলিক থেরাপি নির্ধারণ করতে পারে।
খাদ্যাভ্যাসও এই মেটাবোলিক থেরাপির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, কিটোজেনিক ডায়েট (কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে চর্বি বেশি গ্রহণ করা) কিছু ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল দিতে পারে, কারণ এটি শরীরের শক্তি উৎপাদনের প্রধান উৎসকে গ্লুকোজ থেকে কিটোন বডিতে স্থানান্তরিত করে, যা ক্যান্সার কোষের জন্য ব্যবহার করা কঠিন হতে পারে। তবে, এই বিষয়ে আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন।
মেটাবোলিক থেরাপি এখনও তার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং এর সফল প্রয়োগের জন্য আরও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ও গবেষণা প্রয়োজন। তবে, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি একটি নতুন এবং প্রতিশ্রুতিশীল ফ্রন্ট উন্মোচন করেছে। ক্যান্সার কোষের জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে, এই নতুন কৌশলটি একদিন রোগীদের জন্য আরও কার্যকর এবং কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিশিষ্ট চিকিৎসার পথ খুলে দিতে পারে, যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে আমাদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করবে।