রোকসানা বেগম, পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এক প্রৌঢ়া, নিঃসন্তান, বিধবা। ছোট একটা মফস্বল শহরে একা থাকেন। সম্প্রতি তাঁর শরীরে ধরা পড়েছে স্তন ক্যান্সার। কিন্তু চিকিৎসার চেয়ে তাঁর মনে এক অন্যরকম তীব্র জ্বালা—একটা প্রশ্ন বারবার গুঞ্জন তোলে মনে: “আমি কি পাপ করেছি? কী পাপ করেছি…”
রোকসানা রাতে ঘুমোতে পারেন না। পাশের দেওয়ালে একটি ক্যালেন্ডারে শোভা পাচ্ছে সুন্দরতম এক মসজিদের ছবি, নিচে লেখা—“আল্লাহর ইচ্ছাই সব।” তাঁর মা-খালারা বলতেন, “রোগ-ব্যাধি আসে পাপের শাস্তি হয়ে।” মনে পড়ে যায় অতীতের কথা। তিনি যখন ভরা যৌবনের বেলাভূমিতে মাত্র পা রেখেছেন তখন কি কিছু ভুল হয়েছিল, হয়তো কাউকে কষ্ট দিয়েছেন… তাই কি এই রোগ?
******************************************
পাড়ার কিছু নারীর মন্তব্য রোকসানার কান পর্যন্ত এসেছে—
- “নিশ্চয়ই কোন গোপন পাপ করেছে, না হলে এমন রোগ হয়?”
- “আল্লাহ সব দেখে, শাস্তি দেয় সময়মতো।”
এইসব কথা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে তাঁর মনে। কেমোথেরাপির কষ্টের চেয়েও বেশি যন্ত্রণা দেয় এই প্রশ্নগুলো। তিনি কুরআন পড়েন, নামাজ পড়েন—তবুও ভেতরে বেদনার ঘূর্ণিপাক।
******************************************
একদিন ক্যান্সার সেন্টারে তাঁর পরিচয় হয় রেহানা নামের এক অদ্ভুত আশ্চর্য নারীর সাথে। রেহানা টার্মিনাল ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত, অথচ মুখে যেন অদ্ভুত এক প্রশান্তি।
রোকসানা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কষ্ট পাও না? ভয় পাও না মৃত্যুকে?”
রেহানা হাসলেন। “ভয়? কেন? মৃত্যু তো জীবনের অংশ। আর ক্যান্সার তো রোগ, পাপ না। দুনিয়ায় যারা কষ্ট পায়, তারাই তো আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়।”
রোকসানা প্রথমবারের মতো থমকে গেলেন।
******************************************
রাত্রে শুয়ে রোকসানা অতীত খোঁজেন—একসময়ে বোনকে হিংসা করেছিলেন, স্বামীকে কখনো গাল দিয়েছিলেন। এইসব মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিন্তু আবার মনে পড়ে রেহানার কথা: “মানুষ ভুল করবেই, কিন্তু তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন।”
সকালে উঠে ওজু করে নামাজ শেষে তিনি কাঁদেন, কিন্তু এইবার ক্ষমা চেয়ে নয়, একধরনের মুক্তির আনন্দে। নিজের শরীরকে ঘৃণা না করে তিনি এবার চিকিৎসার প্রতি মন দেন।
হাসপাতালে একদিন চিকিৎসক বলেন, “আপনার রিপোর্ট উন্নতির দিকে। আশা আছে।”
রোকসানা বাইরে এসে সূর্যের দিকে তাকান। মনে হয়, বহুদিন পর আলো দেখছেন। তিনি স্থির করেন, রোগকে পাপ নয়, শিক্ষার একটি অংশ হিসেবে নেবেন। তাঁর গল্প এখন অন্যদের জন্যও অনুপ্রেরণা—অনেক নারী তাঁর থেকে সাহস পান।
******************************************
শেষ রাতে আবার সেই প্রশ্ন ওঠে মনে—“আমি কী পাপ করেছি?”
তিনি আয়নায় তাকান, নিজের কেমোতে হারিয়ে যাওয়া চুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “পাপ নয়, এটা এক পরীক্ষা। হয়তো আল্লাহ আমার ভেতরের শক্তিটা আমাকে দেখাতে চেয়েছেন।”
রোকসানা জানেন, পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ পাপ করে, কিন্তু সে পাপ কখনো ক্যান্সারের রূপে আসে না। রোগ আসে জৈবিক কারণে, পরিবেশের কারণে, ভাগ্যের কারণে—তবে তা কখনোই আল্লাহর ‘শাস্তি’ নয়।