ভাবুন তো একবার, এমন এক চিকিৎসা পদ্ধতির কথা যা কেবল শব্দ ব্যবহার করেই ক্যান্সারের কোষগুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারে! চোখের সামনেই যেন মিলিয়ে যাচ্ছে টিউমার কোষ, এমনই এক বিস্ময়কর দৃশ্য। এই যুগান্তকারী প্রযুক্তির নাম হিস্টোট্রিপসি।
হিস্টোট্রিপসি কী?
হিস্টোট্রিপসি হলো এমন একটি অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি যেখানে কোনো রকম অস্ত্রোপচার ছাড়াই, শুধুমাত্র আলট্রাসাউন্ড বা শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট রোগাক্রান্ত কোষকে ভেঙে ফেলা হয়। এই পদ্ধতিটি ক্যান্সার চিকিৎসার জগতে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের হাত ধরে এর পথচলা শুরু হয়েছিল এবং পরবর্তীতে মিনিয়াপলিস-ভিত্তিক কোম্পানি হিসোসনিক্স (HistoSonics) এটিকে ক্লিনিক্যাল ব্যবহারের জন্য উন্নত করেছে।
প্রায় ২০ বছরের দীর্ঘ যাত্রার পর, হিস্টোট্রিপসি লিভার ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA)-এর অনুমোদন পেয়েছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে হাসপাতালগুলোতে হিসোসনিক্স-এর তৈরি হিস্টোট্রিপসি ডেলিভারি ডিভাইস ব্যবহার করার পথ খুলে গেল।
কীভাবে কাজ করে এই প্রযুক্তি?
হিস্টোট্রিপসি পদ্ধতিতে মাইক্রোসেকেন্ড স্থায়ী আলট্রাসাউন্ড পাল্স ব্যবহার করা হয়। এই শব্দতরঙ্গ আমাদের শরীরের ভেতরে থাকা ন্যানোমিটার আকারের গ্যাস পকেটগুলোকে সক্রিয় করে তোলে, যার ফলে মাইক্রো বাবল বা অতিক্ষুদ্র বুদবুদ তৈরি হয়। এই বুদবুদগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রসারিত ও সংকুচিত হয়ে প্রচন্ড যান্ত্রিক চাপ সৃষ্টি করে এবং টিউমার কোষের মতো রোগাক্রান্ত কোষগুলোকে ভেঙে ফেলে।
প্রচলিত চিকিৎসার চেয়ে কতটা আলাদা?
লিভার ক্যান্সার শনাক্ত হতে প্রায়ই দেরি হয়ে যায়, এবং শেষ পর্যায়ে সার্জারি করা সম্ভব হয় না। তখন কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনের মতো চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এই প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে এবং সুস্থ হতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে, এমনকি দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিও হতে পারে।
অন্যদিকে, হিস্টোট্রিপসি অনেক বেশি নির্ভুলভাবে টিউমারের উপর কাজ করে এবং রোগীর সেরে ওঠার সময়ও খুব কম লাগে। অনেক রোগী অস্ত্রোপচারের পর কোনো ব্যথা অনুভব করেন না এবং প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে কিনা তা নিয়েও জিজ্ঞাসা করেন। তারা সাধারণ অ্যানেস্থেসিয়া থেকে বেরিয়েই উঠে দাঁড়াতে এবং হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারেন।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এবং সাফল্য
ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘হোপ ফর লিভার’ (hope4liver) ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সময় প্রাথমিক এবং মেটাস্ট্যাটিক লিভার টিউমারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় হিস্টোট্রিপসি ব্যবহার করে এর কার্যকারিতা প্রমাণ করা হয়েছে। হিসোসনিক্স-এর তৈরি এডিসন প্ল্যাটফর্ম (Edison platform) নামক একটি রোবোটিক হাতের সাহায্যে এই চিকিৎসা চালানো হয়। সাধারণ আলট্রাসাউন্ড ডিভাইসের মতোই এটিকে পেটের উপরে স্থাপন করা হয় এবং চিকিৎসকরা এর মাধ্যমে টিউমারকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে লক করেন। এর পরের পুরো প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
মানুষের উপর সফল পরীক্ষা এবং এফডিএ-র অনুমোদনের পর হাসপাতালগুলো এখন এডিসন প্ল্যাটফর্ম কিনতে পারবে, যা হিস্টোট্রিপসিকে একটি কার্যকর বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন যে, এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে শুধু লিভার ক্যান্সারেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং কিডনি, অগ্ন্যাশয় এবং এমনকি নিউরোলজিক্যাল ও কার্ডিওভাসকুলার রোগের চিকিৎসাতেও এর প্রয়োগ সম্ভব হবে। ক্যান্সার চিকিৎসায় হিস্টোট্রিপসি এবং ইমিউনোথেরাপির মতো অন্যান্য পদ্ধতির সম্মিলিত ব্যবহার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবায় এই প্রযুক্তির সম্ভাবনা সত্যিই অপরিসীম।