ক্যান্সার নতুন কোনো রোগ নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া ১৬-১৮ লক্ষ বছর আগের এক মানবদেহের হাড়ে ক্যান্সারের চিহ্ন পাওয়া গেছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ সালের দিকে মিশরের চিকিৎসক ইমহোতেপ স্তনে এক ধরনের কঠিন ফোলা রোগের বিবরণ দেন, যার চিকিৎসা প্রাচীন পৃথিবীর কোনো পদ্ধতিতেই সম্ভব ছিল না।
প্রাচীনকালে “ক্যান্সার” শব্দটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে খুব একটা ব্যবহৃত হতো না, তবে বিভিন্ন লেখায় টিউমার বা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে, যেগুলো সম্ভবত ক্যান্সারেরই রূপ। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে “কারকিনোস” শব্দটি ব্যবহার করেন এই ধরনের ফোলাকে বোঝাতে—এটাই সম্ভবত “ক্যান্সার” শব্দের শুরুর দিকের ব্যবহার।
অন্ধকার যুগ থেকে বৈজ্ঞানিক আলোর দিকে
মধ্যযুগে ক্যান্সারকে অনেক সময় ‘অশুভ শক্তি’র ফল বা ‘খারাপ শরীররস’-এর কারণে হয়েছে বলে মনে করা হতো। চিকিৎসাও ছিল সীমিত, অনেক সময় অস্ত্রোপচারই ছিল একমাত্র ভরসা, যা অনেক ক্ষেত্রে রোগীর কষ্টই বাড়াতো।
পুনর্জাগরণ (Renaissance) যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞানে আবার অগ্রগতি শুরু হয়। ১৭শ শতকে মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কার হওয়ায় মানুষের শরীরের কোষগত গঠন বোঝার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এরপর ১৯শ শতকে রুডলফ ভিরখোর মতো প্যাথলজিস্টরা দেখান যে ক্যান্সার কোষজনিত একটি রোগ। এতে চিকিৎসার ধারা নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে।
সার্জারি থেকে শুরু করে রেডিয়েশন ও হরমোন থেরাপি
২০শ শতকের শুরুতে ক্যান্সার চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় আশার নাম ছিল অস্ত্রোপচার। উইলিয়াম হালস্টেড নামক সার্জন ক্যান্সার টিউমার অপসারণে ‘র্যাডিকাল’ সার্জারির পথ দেখান। এনেসথেশিয়ার উন্নতির কারণে জটিল অপারেশনও নিরাপদ হয়ে ওঠে।
কিন্তু শুধুমাত্র অস্ত্রোপচারে সব ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্ভব নয়। তখনই রেডিয়েশন থেরাপির আবির্ভাব ঘটে। মেরি কুরি ও তাঁর সহযাত্রীগণ রেডিয়েশনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টিউমার সংকোচন করার চেষ্টা করেন।
এরপর আসে সিস্টেমিক থেরাপি বা পুরো শরীর জুড়ে কার্যকর চিকিৎসা। ১৮৯৬ সালে ড. জর্জ বিটসনের গবেষণায় দেখা যায়, ডিম্বাশয় অপসারণ করলে কিছু স্তন ক্যান্সার কমে যায়। এ থেকেই হরমোন বা এন্ডোক্রাইন থেরাপির ভিত্তি গড়ে ওঠে। টামোক্সিফেন ছিল প্রথম লক্ষ্যভিত্তিক ওষুধ, যা ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টরে বাঁধা দিয়ে টিউমার কমায়। এর পাশাপাশি এসেছে অ্যারোমাটেজ ইনহিবিটার, এলএইচআরএইচ অ্যাগোনিস্ট ও নতুন সিডিকে৪/৬ ইনহিবিটর।
সাইটোটক্সিক কেমোথেরাপি: এক যুগান্তকারী আবিষ্কার
মধ্য ২০শ শতকে কেমোথেরাপির যুগ শুরু হয়। বিজ্ঞানীরা এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান আবিষ্কার করেন, যেগুলো দ্রুত বিভাজিত কোষ ধ্বংস করতে পারে—যেমন ক্যান্সার কোষ।
এই থেরাপিতে রয়েছে নানা ধরন—আলকাইলেটর, অ্যান্টিমেটাবোলাইট, অ্যান্টিবায়োটিক, টোপোয়েইসোমারেস ইনহিবিটার, মাইক্রোটিউবিউল ইনহিবিটার এবং প্লাটিনামভিত্তিক ওষুধ। যদিও প্রাথমিক কেমোথেরাপি ছিল কঠোর, এর ভিত্তিতেই আজকের সহনশীল ও কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতির জন্ম।
কিছু ক্ষেত্রে হাই ডোজ কেমোথেরাপির পর নিজস্ব বা দাতার বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করাও হয়ে থাকে—বিশেষ করে কিছু লিউকেমিয়ায়।
টার্গেট থেরাপি ও মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি: ক্যান্সারের ঘাঁটি লক্ষ্য করে আঘাত
১৯৭৫ সালে মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ও ৮০’র দশকে অনকোজিন আবিষ্কারের ফলে টার্গেট থেরাপি এগিয়ে যায় অনেক দূর।
হারসেপ্টিন (Trastuzumab) ছিল প্রথম মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি, যা হার-২ পজিটিভ স্তন ক্যান্সারে ব্যবহৃত হয়। পার্টুজুম্যাবের সাথে এর যুগল ব্যবহারে রোগীর সার্ভাইভাল বেড়েছে অনেক বেশি।
এছাড়া, অ্যান্টিবডি-ড্রাগ কনজুগেট (ADC) যেমন ‘এন-হার্-টু’, কেমোথেরাপি সুনির্দিষ্টভাবে ক্যান্সার কোষে পৌঁছে দেয়। বর্তমানে এফডিএ ১৫টির বেশি ADC অনুমোদন দিয়েছে।
একইভাবে, “গ্লিভেক” (Gleevec) নামে ওষুধটি ফিলাডেলফিয়া ক্রোমোজোম যুক্ত লিউকেমিয়া ও জিআইএসটি-তে (GIST) বিপ্লব এনেছে—যেখানে আগে একমাত্র চিকিৎসা ছিল বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট।
ইমিউনোথেরাপি: শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ শক্তিকে কাজে লাগানো
২১শ শতকের শুরুতে চিকিৎসা আরো এক ধাপে এগিয়ে যায়—ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে। শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রশিক্ষিত করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করানো হয়।
এখানে ব্যবহৃত হয়:
- চেকপয়েন্ট ইনহিবিটর (PD-1/PD-L1) – যেমন ‘কিট্রুদা’ (Keytruda), যা একাধিক ক্যান্সারে কার্যকর।
- CAR-T সেল থেরাপি – যেখানে রোগীর টি-সেলকে জিনগতভাবে পরিবর্তন করে ক্যান্সারকে লক্ষ্য করানো হয়।
- TILs থেরাপি, Natural Killer (NK) সেল থেরাপি, ডেনড্রিটিক সেল থেরাপি ও সাইটোকাইন ইনফিউশন থেরাপি—সবই রোগীর প্রতিরোধ ব্যবস্থা জাগিয়ে তোলে।
ক্যান্সার ভ্যাকসিন: প্রতিরোধ ও চিকিৎসার নতুন দিগন্ত
এই থেরাপিতে দুটি ধরন:
- প্রতিরোধমূলক: যেমন HPV ভ্যাকসিন (সার্ভিক্যাল ক্যান্সার প্রতিরোধে) ও হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন (লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধে)।
- চিকিৎসামূলক: যেমন Provenge, যা অ্যাডভান্সড প্রোস্টেট ক্যান্সারে ব্যবহৃত হয়।
বর্তমানে গবেষণা চলছে পার্সোনালাইজড ক্যান্সার ভ্যাকসিন নিয়ে, যা নির্দিষ্ট ব্যক্তির টিউমারের জন্য তৈরি হয়।
ভবিষ্যতের দিগন্ত: বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আশার আলো
আজকের দিনে আমরা Precision Medicine-এর যুগে প্রবেশ করেছি—প্রতিটি রোগীর জিনগত প্রোফাইল অনুযায়ী চিকিৎসা নির্ধারিত হচ্ছে।
ক্রিসপার (CRISPR) প্রযুক্তি, ন্যানোটেকনোলজি, লিকুইড বায়োপসি ও নেক্সট-জেনারেশন সিকোয়েন্সিং আমাদের আরও দ্রুত, নির্ভুল ও কম ব্যয়বহুল চিকিৎসার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশেও এখন ক্যান্সার চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আধুনিক কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি, সার্জারি এবং কিছু ক্ষেত্রে টার্গেট থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপি দেশের বিভিন্ন ক্যান্সার সেন্টারে (যেমন NICRH, Square, Delta, United Hospital, BMU) দেওয়া হচ্ছে। দেশের জনগণের জন্য এর মানে হচ্ছে—আরো সচেতনতা, আগাম শনাক্তকরণ এবং জীবনরক্ষা।