গামা নাইফ রেডিওসার্জারি শুনলেই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে—”নাইফ” অর্থ অস্ত্রোপচার, আবার “রেডিওসার্জারি” তাও কেমন? আদতে এটি একটি আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে কোনো কাটাছেঁড়ার প্রয়োজন হয় না, অথচ টিউমার ধ্বংস করা যায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। বিশেষত মস্তিষ্কের টিউমার বা ব্রেইন মেটাস্টেসিসের চিকিৎসায় এই প্রযুক্তি আজ বিশ্বজুড়ে এক অনন্য স্থান করে নিয়েছে।
গামা নাইফ রেডিওসার্জারি কী?
গামা নাইফ রেডিওসার্জারি হলো একপ্রকার “অত্যন্ত নিখুঁত রেডিয়েশন থেরাপি”, যেখানে একাধিক দিক থেকে উচ্চশক্তির গামা রশ্মি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে—মানে টিউমারে—প্রয়োগ করা হয়। এটি এমনভাবে পরিকল্পিত যে সুস্থ ব্রেইন টিস্যু বা কোষের উপর কোনো উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না করেই শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত কোষ বা টিউমারকে ধ্বংস করে।
অনেকেই গামা নাইফকে রেডিয়েশনের “স্নাইপার গান” হিসেবে অভিহিত করেন—একেবারে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে, আশেপাশে ক্ষতি না করেই।
কেন ব্যবহার করা হয়?
বিশেষত নিচের ক্ষেত্রে গামা নাইফ ব্যবহৃত হয়:
- মেটাস্টেটিক ব্রেইন টিউমার (যেখানে ক্যান্সার শরীরের অন্য অঙ্গ থেকে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়েছে)
- মেনিনজিওমা বা ব্রেইনের বিনাইন টিউমার
- ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়ার মতো ব্রেইনের স্নায়ুগত ব্যথা
- অ্যার্টেরিওভেনাস ম্যালফরমেশন (AVM)
- অ্যাকউস্টিক নিউরোমা ইত্যাদি
চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগে কী প্রস্তুতি দরকার?
গামা নাইফ থেরাপির আগে রোগীকে একটি MRI স্ক্যান করানো হয়। এতে ব্রেইনের ভিতরের কাঠামো ও টিউমারের অবস্থান বিস্তারিতভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। এই তথ্য ব্যবহার করে চিকিৎসক ও পদার্থবিদ দল মিলেই পুরো থেরাপির পরিকল্পনা করে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে CT স্ক্যানও প্রয়োজন হয়, বিশেষত ফ্রেম ভিত্তিক (framed) থেরাপিতে।
ফ্রেম বনাম ফ্রেমলেস থেরাপি
গামা নাইফ দুইভাবে করা যায়—একটি হলো “ফ্রেমযুক্ত”, যেখানে মাথায় চারটি পিনের সাহায্যে একটি ধাতব ফ্রেম আটকানো হয়। অন্যটি হলো “ফ্রেমলেস”, যেখানে থার্মোপ্লাস্টিক মাস্ক দিয়ে মাথাকে স্থির রাখা হয়। উভয় ক্ষেত্রেই মূল উদ্দেশ্য একটাই—চিকিৎসার সময় মাথাকে একেবারে স্থির রাখা।
এই লেখায় আমরা মূলত ফ্রেমযুক্ত চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করছি।
চিকিৎসার দিনে কী হয়?
চিকিৎসার দিন সকালেই রোগীর মাথায় স্নায়ুর সার্জনের সহায়তায় ফ্রেম পরানো হয়। ফ্রেমের পিন বসানোর আগে স্থানীয়ভাবে অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয় যাতে ব্যথা না লাগে। ফ্রেম পরানোর পরে রোগী আর চশমা ব্যবহার করতে পারবেন না।
এরপর হয় CT স্ক্যান—যার মাধ্যমে টিউমারের গঠন আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। এরপর MRI ও CT এর ছবি মিলিয়ে রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট একটি নির্দিষ্ট ৩D ম্যাপ তৈরি করেন এবং ঠিক করেন কী পরিমাণ গামা রশ্মি কোন কোন কোণে দিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
সার্বিক সময়কাল
চিকিৎসা ১ থেকে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় নিতে পারে, যা নির্ভর করে টিউমারের আকার, সংখ্যা ও অবস্থানের উপর। এই সময় রোগীকে শোয়ানো হয় একটি নির্দিষ্ট টেবিলে। ফ্রেমটি তখন গামা নাইফ মেশিনে লাগানো থাকে, এবং গামা রশ্মি নির্ধারিত কোণে ছোঁড়ার মাধ্যমে টিউমার ধ্বংস করা হয়।
অনুভব কেমন হয়?
সার্জারি চলাকালে কোনো ব্যথা বা কাটা-ছেঁড়ার অনুভব হয় না। তবে দীর্ঘ সময় মাথা একভাবে রেখে শুয়ে থাকায় অল্প কিছু অস্বস্তি হতে পারে। এই সময় রোগী চাইলে গান শুনতে পারেন বা ঘুমিয়েও পড়তে পারেন।
চিকিৎসা শেষে কী হয়?
চিকিৎসা শেষ হলে মাথা থেকে ফ্রেম খুলে ফেলা হয়। পিন বসানো স্থানে সামান্য রক্তপাত হতে পারে, যা ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা হয়। এগুলো ২৪ ঘণ্টা শুকনো রাখা জরুরি যাতে সংক্রমণ না ঘটে।
এরপর রোগীকে কমপক্ষে এক ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। মাথাব্যথা থাকলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। সাধারণত সেদিনই রোগীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্যই পরিবার বা বন্ধুর সাহায্যে যাওয়া উচিত, কারণ কিছু ওষুধের প্রভাবে রোগী কিছুটা ঘুম ঘুম থাকতে পারেন।
চিকিৎসার পরবর্তী সময়
চিকিৎসার পর রোগী নিজের স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করতে পারেন। তবে টিউমারের উপর নির্ভর করে রেডিয়েশনের সম্পূর্ণ প্রভাব বুঝতে ৬ থেকে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তাই চিকিৎসার ৩ মাস পরে আবার MRI স্ক্যান করা হয়, এবং পরবর্তী চিকিৎসা পরিকল্পনা ঠিক করা হয়।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
গামা নাইফ সাধারণত নিরাপদ হলেও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে:
- মাথাব্যথা
- মাথার চামড়ায় সামান্য ফোলা
- ক্লান্তি
- বিরল ক্ষেত্রে, রেডিয়েশন নিউরাইটিস বা ব্রেইন টিস্যুতে অস্থায়ী স্ফীতি
এগুলো হলে চিকিৎসককে জানানো উচিত।
স্বাস্থ্যসেবা টিম
গামা নাইফ চিকিৎসার পেছনে থাকে একদল অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সদের সমন্বয়ে গঠিত টিম। এই দলে থাকে:
- রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট
- নিউরোসার্জন
- মেডিকেল ফিজিসিস্ট
- নার্স
- ট্রেনি ডাক্তার ও রেসিডেন্ট
তারা প্রত্যেকে রোগীর মেডিকেল ইতিহাস সম্পর্কে অবগত এবং যৌথভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
উপসংহার
গামা নাইফ রেডিওসার্জারি আজ আধুনিক ব্রেইন টিউমার চিকিৎসায় এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। অপারেশনের ভয়, দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকার ঝামেলা বা কাটা-ছেঁড়ার ভয়—সব কিছু উপেক্ষা করেই রোগী অল্প সময়ের মধ্যেই নিরাপদে চিকিৎসা নিতে পারেন।
তবে প্রতিটি রোগীর অবস্থা আলাদা, তাই চিকিৎসার ধরন নির্ধারণে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।