বয়স্কদের ক্যান্সার বা জেরিয়াট্রিক ক্যান্সার

বয়স বাড়ার সঙ্গে শরীরে কোষের বিভাজন এবং জৈবপ্রতিক্রিয়ার পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে ৬৫ বছর ও ততোধিক বয়সীদের মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৮ মিলিয়ন নতুন ক্যান্সার শনাক্ত হয়; এর মধ্যে ৩০–৪০%ই বছরের শেষভাগে বয়স্কদের মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশেও বয়স্কদের ক্যান্সার বাড়ছে: বর্তমানে ৬৫ বছরের ওপরে জীবিত ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার ছাড়িয়েছে।

ইনসিডেন্স ও প্রিভ্যালেন্স
বিশ্বজুড়ে বয়স্কদের (≥৬৫ বছর) নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার  সংখ্যা মোট ক্যান্সার রোগীর প্রায় অর্ধেক। বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট জাতীয় রেজিস্ট্রি না থাকলেও অনুমান করা হয়, প্রতিবছর ৬৫ বছরের ওপরে প্রায় ২০–২৫% ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়। বৃদ্ধ বয়সে শরীরের প্রতিরক্ষা শক্তি কমে যাওয়ায় এবং বহুমাত্রিক ক্রনিক সমস্যার ফলে এ শ্রেণির রোগীরা তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকিতে থেকে থাকেন।

প্রধান প্রধান ক্যান্সার

  • পুরুষ: থাইরয়েড, খাদ্যনালী, ফুসফুসের ক্যান্সার, কোলরেক্টাল ক্যান্সার এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার।
  • মহিলা: স্তন, থাইরয়েড, সিস্টিক ফাইব্রোএডেনোমা, কোলন ক্যান্সার।

বাংলাদেশে বিশেষ করে স্তন এবং গাইনোকোলজিক্যাল ক্যান্সার বেশি হারে বাড়ছে, কারণ স্ক্রিনিং সুবিধা সীমিত আর জনসচেতনতাও অপর্যাপ্ত।

কারণ ও রিস্ক ফ্যাক্টর

  • জীববৈচিত্র্য হ্রাস: বয়স বাড়লে কোষ বিভাজনের নিয়ন্ত্রণ হারায়।
  • জিন নিয়ন্ত্রণ: দীর্ঘদিনের জৈব-রাসায়নিক এক্সপোজার (ধূমপান, দূষণ) ডিএনএ ক্ষতি ঘটায়।
  • অত্যধিক বিকিরণ: দীর্ঘমেয়াদি সূর্যালোক বা রেডিয়েশন থেরাপি অতিরিক্ত ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
  • প্রচলিত রোগ: ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন – আক্রান্তদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

প্রতিরোধ

  • নিয়মিত স্ক্রিনিং ও স্বাস্থ্য টেস্ট: কলনোস্কোপি, ম্যামোগ্রাম, প্রোস্টেট-স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন (PSA) ইত্যাদি।
  • জীবনযাত্রার পরিবর্তন: ধূমপান ত্যাগ, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, শারীরিক ব্যায়াম।
  • পর্যাপ্ত ভিটামিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গ্রহণ (ফল-মূল, সবুজ শাক-সবজি)।
  • পরিবেশগত দূষণ কমানো: সিগারেট ধোঁয়া, তৈলাক্ত খাদ্য, রাসায়নিক এক্সপোজার নিয়ন্ত্রণ।

প্যালিয়েটিভ কেয়ার ও হসপিস
বয়স্ক ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে প্যালিয়েটিভ কেয়ার অপরিহার্য। এটি শুধু ব্যথা কমায় না, মানসিক শান্তি, পারিবারিক সমর্থন এবং মানসম্মত জীবন নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে প্যালিয়েটিভ সেবার প্রাপ্যতা সীমিত থাকায় রোগী ও পরিবারের মানসিক ভোগান্তি বেড়ে যায়।

  • বাস্তবায়ন: সরকারি হাসপাতাল, এনজিও ও বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে প্যালিয়েটিভ ইউনিট গড়ে তোলা জরুরি।
  • হসপিস: বিশেষায়িত ‘হসপিস’ সেন্টার, যেখানে টার্মিনাল ফেজের রোগীরা পরিবারের সান্নিধ্যে শেষ দিনগুলো শান্তিতে কাটাতে পারেন। সেখানকার পেশাদার নার্স, সোশ্যাল ওয়ার্কার ও থেরাপিস্টরা সার্বক্ষণিক সহায়তা প্রদান করেন।

শেষকথাঃ
৬৫ বছরের পর শরীর ও মন দুটোরই যত্ন প্রয়োজন। ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতা ও নিয়মিত স্ক্রিনিংই সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। পাশাপাশি, যখন রোগী ক্রনিক কিংবা টার্মিনাল ফেজে পৌঁছে, তখন প্যালিয়েটিভ কেয়ার ও হসপিসের ভূমিকা অনন্য—ব্যথা কমিয়ে, সম্মানজনক জীবন ও মৃত্যুর সুযোগ এনে দেয়। বয়স্কদের ক্যান্সার শুধু চিকিৎসার বিষয় নয়, সামাজিক এবং মানসিক সহায়তার বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলারও বিষয়।  ভালো জীবন এবং শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি সব বয়স্ক রোগীরই অধিকার।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *