রুমের কোণায় রাখা একটা হুইলচেয়ার। জানালার পাশের খোলা বাতাসে পর্দা দুলছে। হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে এই একঘেয়ে দুপুরগুলোয় সময় যেন পেরোয় না। তবুও শামসুন নাহার চুপচাপ বসে আছেন। ছেলেটা একটু আগে বলে গেছে, “মা, আপনি শক্ত থাকবেন তো, তাই না?”
তিনি হেসে মাথা নেড়েছিলেন, কিন্তু মনে মনে ভেঙে পড়েছিলেন।
‘শক্ত’ শব্দটা যেন তার চারপাশে একটানা প্রতিধ্বনি তোলে। কতবার শুনেছেন—ডাক্তারের মুখ থেকে, নার্সের হালকা হাসির ভেতর, এমনকি প্রতিবেশিনীর ফোনকলেও। সবাই বোঝাতে চায়, তিনি যেন ভেঙে না পড়েন।
কিন্তু কেউ একবারও জিজ্ঞেস করেনি—“আপনার ভয় করে কি?”
অথচ ভয়ই তো এখন তার স্থায়ী সঙ্গী।
=====================================================
প্রথমবার যখন ডাক্তার বলেছিল “ম্যালিগন্যান্ট টিউমার”, শামসুন কিছুই বুঝতে পারেননি। পাশে বসা ছেলে আবির তখন চুপ করে বসে ছিল। তারপর থেকে তাদের জীবনে একটা নতুন পর্ব শুরু হয়—কেমো, বমি, শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া, চুল পড়ে যাওয়া, মানুষজনের করুণা মাখানো হাসি।
তবে সবচেয়ে যেটা কষ্ট দেয়—সেটা হচ্ছে ‘অভিনয়’।
সবাই যেন এক অদ্ভুত সামাজিক নিয়মে বাধা, যেন একজন ক্যান্সার রোগীর সামনে চোখে জল রাখা মানা। সবাই বলে, “শক্ত থেকো”, “তুমি পারবে”, “পজিটিভ থাকো”।
কেউ বলে না, “তুমি আজ কেমন আছো?”
কেউ বলে না, “ভয় পাচ্ছো?”
=====================================================
হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছে নতুন একজন রোগী। বয়স তিরিশ হবে। মুখে চুপচাপ ক্লান্তির ছাপ। মেয়েটিকে দেখে শামসুন একরকম নিজের ছায়া দেখতে পান।
হাসিমুখে ডেকে বললেন, “এসো মা, এখানে বসো।”
মেয়েটি লাজুকভাবে এসে বসল। নাম—রিতা।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর রিতা বলল, “আন্টি, সবাই বলে আমি নাকি খুব সাহসী… অথচ রাতে একা থাকলে আমার খুব কান্না পায়।“
শামসুনের চোখে জল চলে আসে।
তিনি বললেন, “তুমি কান্না করো মা, সাহস মানে তো কান্না চেপে রাখা না। সাহস মানে, ভয় থাকা সত্ত্বেও সামনে এগিয়ে যাওয়া।”
=====================================================
সেদিন দুপুরবেলা হঠাৎ রিতার শরীর খারাপ হয়। অক্সিজেন লেভেল কমে যায়। সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। শামসুন হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে চান, পারেন না। হাত বাড়িয়ে শুধু বলেন, “ওকে বলো আমি এখানে আছি।”
রিতাকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকঘণ্টা পর অবস্থা স্থিতিশীল হয়। ডাক্তার যখন জানালেন, এখন আপাতত বিপদ কেটে গেছে, তখন শামসুন নিঃশ্বাস ফেলেন। চোখে জল—শুধু রিতার জন্য না, নিজের জন্যও। তিনি বুঝলেন—নিজেও কারও বোঝা নন, তিনিও কাউকে বোঝাতে পারেন, সাহস মানে একা না থাকা।
=====================================================
তিনদিন পর শামসুনের ছেলের ফোন আসে—“মা, নতুন রিপোর্ট এসেছে। ডাক্তার কিছু বলতে চান।”
ডাক্তার চেম্বারে বসে বললেন, “ম্যাডাম, এটা একটু দুর্লভ ঘটনা। আপনার শরীরে টিউমারের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা এখন কেমো বন্ধ রেখে পর্যবেক্ষণে যাবো।”
শামসুন হেসে বললেন, “না বাবা, আমি শক্ত ছিলাম না। আমি শুধু একা ছিলাম না। রিতা ছিল, আর সেই ছোট্ট মেয়েটা যে বলেছিল—‘আমার কান্না পায়’—সে ছিল। এই বোঝার মানুষগুলো ছিল বলেই আজ আমি এখানে।”