১: এলিয়টের ঘরে মৃত্যুর ছায়া
দরজায় কড়া নাড়ছে মৃত্যু। মৃদু আলোয় বসে থাকা এলিয়টের মুখে আতঙ্ক ও প্রত্যাশা একসঙ্গে খেলা করছে। বছরখানেক আগে তার কোলন ক্যান্সার ধরা পড়ে। অস্ত্রোপচার হয়েছে, কেমোথেরাপিও শেষ। তবুও, তার রক্তে রয়ে গেছে ক্যান্সার কোষের ডিএনএ – এক ভয়ঙ্কর বার্তা, যা বলে দেয়, ক্যান্সার হয়তো আবার ফিরে আসবে।
কিন্তু এলিয়ট এবার ভয় পাচ্ছেন না। তিনি স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছেন এক যুগান্তকারী চিকিৎসা পরীক্ষায় – ব্যক্তিগতভাবে তৈরি করা ক্যান্সার ভ্যাকসিনের ট্রায়াল। জায়গা: বার্মিংহামের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতাল।
২: ক্যান্সার ভ্যাকসিন — বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত
এই ভ্যাকসিন ব্যবস্থাটি মূলত mRNA প্রযুক্তিনির্ভর, ঠিক যেমন কোভিড-১৯ এর টিকা। তবে পার্থক্য এই যে, এটি প্রতিটি রোগীর ক্যানসারের অনন্য জেনেটিক চিহ্ন বিশ্লেষণ করে তার ভিত্তিতে তৈরি হয়। গবেষকরা রোগীর টিউমার থেকে প্রোটিন নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোর বিরুদ্ধে mRNA ভ্যাকসিন তৈরি করেন, যা শরীরকে নির্দেশ দেয় — এই ‘অচেনা’ প্রোটিনগুলোকে ধ্বংস করো।
এই ভ্যাকসিন ক্যান্সার কোষগুলোকে এমনভাবে টার্গেট করে, যেন শরীরের ইমিউন সিস্টেম নতুন করে জেগে উঠে। রোগীর শরীর নিজেই হয়ে ওঠে ক্যান্সার-বিরোধী এক দুর্ধর্ষ সৈনিক।
৩: “ক্যান্সার ভ্যাকসিন লঞ্চপ্যাড” — এনএইচএসের সাহসী পদক্ষেপ
ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান (NHS) এই চিকিৎসার ট্রায়াল কার্যক্রমের নাম দিয়েছে “Cancer Vaccine Launchpad”। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যা হাজার হাজার রোগীকে এই পরীক্ষামূলক চিকিৎসায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেবে।
এই মুহূর্তে শুধুমাত্র কোলন ক্যান্সারের রোগীদের নিয়ে শুরু হলেও, ভবিষ্যতে স্তন, ফুসফুস, মূত্রাশয়সহ আরও বহু ধরনের ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও এ পদ্ধতির প্রয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রফেসর পিটার জনসন, NHS ইংল্যান্ডের জাতীয় ক্যান্সার লিড, বলেন — “এটি শুধু একটি চিকিৎসা নয়, বরং একটি রূপান্তর। আমরা যদি অপারেশনের পর রোগীদের থেকে দ্রুত টিউমার নমুনা নিয়ে জিনগত বিশ্লেষণ করতে পারি, তবে তার ভিত্তিতে তৈরি ভ্যাকসিনের মাধ্যমে রোগের পুনরাগমন ঠেকানো সম্ভব।”
৪: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার সীমানায় দাঁড়িয়ে
তবে সহজ নয় এই পথ। একটি ব্যক্তিগতকৃত ভ্যাকসিন তৈরি করতে লাগে সময়, নির্ভুল বিশ্লেষণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। উদাহরণস্বরূপ, এলিয়টের ভ্যাকসিনটি তৈরি হয়েছে জার্মানির একটি বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে।
এই চিকিৎসা আরও এক চ্যালেঞ্জ তৈরি করে — ইমিউন সিস্টেম কী এত দুর্বল অবস্থায় থেকেও সাড়া দিতে পারবে? ক্যান্সারের পর কেমোথেরাপি কিংবা রেডিওথেরাপির ফলে রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্ত থাকে।
তবে গবেষকদের আশা — এই ভ্যাকসিন ইমিউন সিস্টেমকে এমনভাবে প্রলুব্ধ করবে, যা সাধারণ ওষুধ কখনো পারে না।
৫: আশা, যা কাঁপিয়ে দেয় চিকিৎসাবিজ্ঞানকে
এলিয়ট এখনো বেঁচে আছেন। তিনি মোট ১৫টি ডোজ পাবেন এই ভ্যাকসিনের। প্রতিটি ডোজ যেন মৃত্যুকে আরও কিছুটা দূরে ঠেলে দেয়।
এই ট্রায়াল কেবল তার জীবনের গল্প নয় — এটি একটি বৈপ্লবিক উদ্যোগ, যা ভবিষ্যতে ক্যান্সার চিকিৎসার চিত্রই বদলে দিতে পারে। যদি এটি সফল হয়, তবে হয়তো একদিন প্রতিটি ক্যান্সার রোগী অপারেশনের পরপরই পাবেন তার নিজস্ব ভ্যাকসিন, তার শরীরের জন্য একেবারে কাস্টমাইজড।
উপসংহার: বিজ্ঞান যখন ব্যক্তিগত হয়
ব্যক্তিগত ভ্যাকসিন — শোনার মতো বিলাসী ধারণা ছিল এক সময়। কিন্তু আজকের জেনেটিক বিশ্লেষণ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, এবং দ্রুত mRNA উৎপাদনের যুগে এটি বাস্তব।
এক সময় ক্যান্সার ছিল অনিবার্য মৃত্যুবার্তা। এখন, হয়তো সেটি হয়ে উঠবে কেবল এক যুদ্ধ — যেটি আমরা জিততে পারি।
এলিয়টের মতো হাজারো রোগীর জীবন আজ নির্ভর করছে এই গবেষণার ওপর। এবং সেই গবেষণা আমাদের বলে — “মৃত্যুকে থামানো না গেলেও, তাকে দেরি করানো যায়। আর তাতে যদি জীবন আরও কিছু সময় পায় — তবে সেটাই তো সবচেয়ে বড় জয়।”