চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে। ক্যান্সার নামক মারণব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজ্ঞানীরা এক যুগান্তকারী পথের সন্ধান পেয়েছেন, যা প্রচলিত সব ধারণাকে বদলে দিতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (KAIST)-এর একদল গবেষক এমন এক চিকিৎসা পদ্ধতির উন্মোচন করেছেন, যা ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস না করে, বরং সেগুলোকে পুনরায় স্বাভাবিক ও সুস্থ কোষে রূপান্তরিত করে। এটি কেবল একটি নতুন চিকিৎসা নয়, বরং ক্যান্সারের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের দর্শনকেই বদলে দেওয়ার এক বিশাল পদক্ষেপ।
প্রচলিত চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা ও নতুন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা
ক্যান্সার চিকিৎসার কথা ভাবলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশনের মতো পদ্ধতির ছবি। এই চিকিৎসাগুলোর মূল নীতি হলো—আক্রমণাত্মকভাবে বিভাজিত হওয়া ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করা। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় একটি বড় সমস্যা হলো, এই পদ্ধতিগুলো সুস্থ কোষ এবং ক্যান্সার কোষের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। ফলে, ক্যান্সার কোষের পাশাপাশি রোগীর শরীরের দ্রুত বিভাজনশীল সুস্থ কোষগুলোও (যেমন: চুলের ফলিকল, পরিপাকতন্ত্রের কোষ) ধ্বংস হয়ে যায়। এর পরিনামস্বরূপ রোগীকে চুল পড়া, বমিভাব, ক্ষুধামান্দ্য, শারীরিক দুর্বলতা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের মতো মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় কিছু ক্যান্সার কোষ এই চিকিৎসা প্রতিরোধ করে টিকে থাকে এবং পরে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে, যাকে বলা হয় ক্যান্সারের পুনরাবির্ভাব (Relapse)।
এই সীমাবদ্ধতাগুলোই বিজ্ঞানীদের নতুন পথের সন্ধানে উৎসাহিত করেছে। তাঁরা এমন একটি পদ্ধতির খোঁজে ছিলেন, যা শুধুমাত্র ক্যান্সার কোষকে লক্ষ্যবস্তু বানাবে এবং সুস্থ কোষকে অক্ষত রাখবে। কাইস্টের গবেষকদের এই নতুন আবিষ্কার ঠিক সেই লক্ষ্যই পূরণ করেছে।
উদ্ভাবনের নেপথ্যে: ডিজিটাল টুইন ও মলিকিউলার সুইচ
কাইস্টের বায়োসায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক চো ওয়াং-হিউন এবং তাঁর দলের এই যুগান্তকারী সাফল্যের পেছনে রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং গভীর জীববৈজ্ঞানিক জ্ঞান। তাঁদের পদ্ধতির মূল ভিত্তি দুটি:
১. ডিজিটাল টুইন (Digital Twin): গবেষকরা প্রথমে ক্যান্সার কোষের একটি অত্যন্ত জটিল এবং নিখুঁত কম্পিউটার মডেল তৈরি করেন, যাকে বলা হয় ‘ডিজিটাল টুইন’। এটি কোনো সাধারণ সিমুলেশন নয়, বরং এটি একটি কোষের সম্পূর্ণ জেনেটিক এবং মলিকিউলার নেটওয়ার্কের ভার্চুয়াল প্রতিরূপ। এই ডিজিটাল মডেলে গবেষকরা বিভিন্ন জিন ও প্রোটিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে দেখতে পারেন যে, কোষের আচরণে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে। হাজার হাজার সম্ভাব্য পরিবর্তন কম্পিউটারে পরীক্ষা করে তাঁরা সেই মূল কারণটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন, যা একটি সুস্থ কোষকে ক্যান্সার কোষে পরিণত করে।
২. মলিকিউলার সুইচ (Molecular Switch): ডিজিটাল টুইন ব্যবহার করে দীর্ঘ গবেষণার পর, বিজ্ঞানীরা কোষের অভ্যন্তরে এমন কিছু মূল নিয়ন্ত্রক প্রোটিন বা জিনগত পথ (Pathway) শনাক্ত করেন, যা কোষের চরিত্র নির্ধারণ করে। এই নিয়ন্ত্রকগুলো একটি ‘সুইচ’-এর মতো কাজ করে। কোনো কারণে এই সুইচটি ভুল দিকে চলে গেলে কোষ তার স্বাভাবিক ধর্ম হারিয়ে ক্যান্সারের মতো আচরণ শুরু করে। গবেষকদের মূল লক্ষ্য ছিল এই ‘মলিকিউলার সুইচ’ খুঁজে বের করে তাকে পুনরায় সঠিক দিকে ফিরিয়ে দেওয়া।
কোলন ক্যান্সারে সাফল্য এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
গবেষক দলটি প্রাথমিকভাবে কোলন ক্যান্সারের কোষ নিয়ে কাজ শুরু করে। তারা কোলন ক্যান্সার কোষের ডিজিটাল টুইন তৈরি করে এবং সিমুলেশনের মাধ্যমে সেই ‘মলিকিউলার সুইচ’ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়, যা কোষকে ম্যালিগন্যান্ট বা ক্ষতিকর করে তুলেছিল। এরপর তাঁরা একটি বিশেষ কৌশল ব্যবহার করে জীবন্ত ক্যান্সার কোষের মধ্যে সেই সুইচটিকে বন্ধ করে দেন।
ফলাফল ছিল বিস্ময়কর! গবেষণাগারে এবং পরবর্তীতে প্রাণীর ওপর চালানো পরীক্ষায় দেখা যায়, আক্রমণাত্মক ক্যান্সার কোষগুলো তাদের ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে এবং ধীরে ধীরে পুনরায় স্বাভাবিক, সুস্থ কোলন কোষে রূপান্তরিত হয়। রূপান্তরিত কোষগুলো আর অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজিত হচ্ছিল না, বরং শরীরের স্বাভাবিক কোষের মতোই আচরণ করছিল।
অধ্যাপক চো এবং তাঁর দল মনে করেন, এই প্রযুক্তি শুধুমাত্র কোলন ক্যান্সারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। যেহেতু প্রায় সব ধরনের ক্যান্সারের পেছনেই কোষের স্বাভাবিক কার্যকারিতা হারানোর একটি নির্দিষ্ট কারণ থাকে, তাই অন্যান্য ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও একই রকম ‘মলিকিউলার সুইচ’ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। বর্তমানে গবেষক দলটি যকৃত (লিভার), পাকস্থলী এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো অন্যান্য টিউমারের ক্ষেত্রেও একই ধরনের নিয়ন্ত্রক শনাক্ত করার জন্য কাজ করছে।
এই পদ্ধতির তাৎপর্য ও ভবিষ্যৎ পথচলা
এই গবেষণা সফলভাবে মানবদেহে প্রয়োগ করা সম্ভব হলে ক্যান্সার চিকিৎসায় নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলো আসতে পারে:
- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন চিকিৎসা: যেহেতু এই পদ্ধতিতে সুস্থ কোষের কোনো ক্ষতি হয় না, তাই কেমোথেরাপির মতো মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো থাকবে না।
- পুনরাবির্ভাবের ঝুঁকি হ্রাস: প্রচলিত পদ্ধতিতে কিছু ক্যান্সার কোষ বেঁচে গিয়ে রোগ ফিরিয়ে আনে। কিন্তু এই রূপান্তরকারী পদ্ধতিতে ক্যান্সারের মূল কারণকেই পরিবর্তন করা হয়, ফলে রোগ নির্মূল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
- ব্যক্তিভিত্তিক চিকিৎসা: প্রতিটি রোগীর টিউমারের বৈশিষ্ট্য আলাদা। ডিজিটাল টুইন মডেল ব্যবহার করে প্রত্যেক রোগীর জন্য নির্দিষ্ট ‘মলিকিউলার সুইচ’ শনাক্ত করে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।
তবে, এই প্রযুক্তি এখনও তার প্রাথমিক এবং পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। মানবদেহে এর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা প্রমাণের জন্য আরও অনেক গবেষণা এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রয়োজন। এই পথ দীর্ঘ এবং চ্যালেঞ্জিং হলেও, কাইস্টের এই গবেষণা নিঃসন্দেহে ক্যান্সার জয়ের পথে এক বিশাল মাইলফলক। এটি আমাদের এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়, যেখানে ক্যান্সারকে ধ্বংস করার পরিবর্তে তাকে পরিবর্তন করে পরাজিত করা সম্ভব হবে।
Yes That would be very fine and the best achievement in the Carcinoma regards. biplabshilpi@yahoo.com
Thank you very much.
Excellent finding.
Thanks a lot!